রাজপথে দীর্ঘ আন্দোলনের সঙ্গীদের নিয়েই নির্বাচনী জোট গঠন করতে যাচ্ছে বিএনপি। শুধু নির্বাচন নয়, সরকার গঠন করলে সেখানেও শরিকদের জায়গা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করায় শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে ডেকেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ ও কাল এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। জানা গেছে, শরিকদের সাথে বৈঠকে মূলত নির্বাচনকে ফোকাস করা হবে। আগামীতে নির্বাচনী জোট কিভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে তা নিয়ে মিত্রদের পরামর্শ নেবেন তারেক রহমান।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় একত্রে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও এলডিপিসহ আরো কয়েকটি দলের সাথে বৈঠক করবেন তারেক রহমান। আগামীকাল শনিবার বিকেলে তিনি বৈঠক করবেন গণতন্ত্র মঞ্চ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ আরো বেশ কয়েকটি দলের সাথে।
বিএনপি ও যুগপৎ জোটের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে জোট শরিকদের সাথে আসন বণ্টন নিয়ে সরাসরি আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে যুগপতের মিত্রদের সবাইকে সাথে রেখেছেন এবং আগামীতেও রাখবেন, সেই আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করবেন। একই সাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকে ত্যাগ স্বীকার করায় মিত্রদের আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাবেন এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বিদ্যমান ঐক্য অটুট রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করবেন।
তবে জোটের কোনো কোনো নেতা এ-ও বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন এবং দেশও ধীরে ধীরে নির্বাচনমুখী হচ্ছে; সে ক্ষেত্রে শরিকদের নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টিও বিএনপির বিবেচনায় নেয়া উচিত; যাতে করে প্রার্থীরা মাঠে কাজ করতে এবং নির্বাচনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমানের বৈঠকের পাশাপাশি চলতি সপ্তাহের মধ্যে যুগপতের মিত্রদের সাথে আসন বণ্টন নিয়েও বিএনপির প্রাথমিক আলোচনা শুরু হতে পারে। সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে মিত্রদের অনেকের কাছে আসনের তালিকা চাওয়া হয়েছে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বিএনপির দু’টি লিয়াজোঁ কমিটি রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান যুগপতের যেসব দল ও জোটের সাথে সমন্বয় করেন, সেসব দল ও জোটের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আজ শুক্রবার বৈঠক করবেন। অন্য দিকে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যেসব জোট ও দলের সাথে সমন্বয় করেন, তাদের সাথে শনিবার বৈঠক করবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বৈঠকের সম্ভাব্য আলোচনা প্রসঙ্গে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত এবং আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হিসেবে নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অবশেষে একটা স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। এতে আমরা আনন্দিত। আমি মনে করি, আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম করেছি, তাদের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একাত্মতা প্রকাশ করবেন। একই সাথে আগামীতেও ফ্যাসিবাদবিরোধী এই ঐক্য যাতে অটুট থাকে, সেটার ওপরও তিনি গুরুত্ব দিবেন।
বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দেশে একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হয়তো কিছু আলোচনা হবে। এটি অনেকটা সৌজন্য বা শুভেচ্ছামূলক আলোচনার মতো। আশা করি, যেটার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে হয়তো নির্বাচন, আসন বণ্টন বা আরো কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।
জোট গঠন ও আসন বণ্টন নিয়ে তৎপরতা : গত মাসের প্রথম দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, বিএনপি এখন মূলত সেই দলগুলোর সাথে নির্বাচনী জোট ও জাতীয় সরকার গঠনে মনোযোগী, যারা একযোগে আন্দোলনে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। এখন এর বাইরে কিছু ভাবা হচ্ছে না।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দু’টি দলই এবার আলাদাভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, যেহেতু জামায়াতের সাথে নির্বাচনী জোট হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে জামায়াতকে এবার আসন ছাড়েরও কোনো প্রশ্ন আসছে না। এতে করে মিত্রদের জন্য এবার বিএনপির আসন ছাড়ের সংখ্যাও কমে আসবে। এই সংখ্যা এবার ৫০ এর নিচে হতে পারে। অবশ্য গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি যুক্ত হলে বিএনপির নির্বাচনী জোটের মেরুকরণ ভিন্নদিকে মোড় নিতে পারে।
প্রথমদিকে বিএনপির অবস্থান ছিল, এনসিপি তাদের সাথে জোট করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে বিএনপি উদার থাকবে, তাদেরকে কাছে টেনে নেবে। তবে গত কয়েক মাসের পাল্টাপাল্টি রাজনীতি এবং দল ও শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানান বক্তব্যে এনসিপির নেতাদের ওপর অনেকটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল বিএনপি। অবশ্য এখন সেটা কিছুটা কমে এসেছে। সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, এনসিপির জন্য আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির নেতারা এগিয়ে আসলে বিএনপি তাদের স্বাগত জানাবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির চিন্তাভাবনা হচ্ছে, এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব যাদের বিজয়ী হওয়ার মতো সক্ষমতা আছে- এমন কয়েকজনকে আসনে ছাড় দেবে।
জানা গেছে, দীর্ঘ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোর মধ্য থেকে যাদের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো সম্ভাবনা রয়েছে, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেবে বিএনপি। এর বাইরে জোটের ঐক্যের স্বার্থেও কিছু আসন ছাড়বে বিএনপি। এ ছাড়া কয়েকটি ইসলামী ও বামদল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে যুগপতের বাইরে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিল। নির্বাচনী জোটে সম্পৃক্ত হলে বিএনপি তাদেরও কয়েকটি আসন দিতে পারে। মূলত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের জোটই ‘নির্বাচনী জোটে’ রূপ নিবে। তবে দলগুলোর মধ্যে যারা সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে ছিল না, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিবে না বিএনপি।
বিএনপি সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। দলটি তখন শরিকদের জন্য মোট ৫৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে জামায়াতসহ তৎকালীন ২০ দলীয় জোটকে ৪০টি আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ছেড়েছিল ১৯টি আসন।
ওই নির্বাচনে তৎকালীন ২০ দলীয় জোটভুক্ত জামায়াতকে ২২টি, এলডিপি ৫টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ২টি, খেলাফত মজলিস ২টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ৪টি, কল্যাণ পার্টি ১টি, লেবার পার্টি ১টি, এনপিপি ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ১টি এবং পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশকে (পিপিবি) ১টি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। অন্য দিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরাম ৭টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ৪টি, নাগরিক ঐক্য ৪টি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে ৪টি আসন ছাড় দিয়েছিল।