বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে পর্যটন খাত। ভরা মওসুমে লাভের পরিবর্তে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য সারা দেশে এ খাতে যে পরিমাণ ব্যবসা হয় তার সবচাইতে বড় অংশ আসে সেন্টমার্টিন থেকে। কিন্তু সেন্টমার্টিন যাতায়াতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপে বছরে চার শ’ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাবনার এ খাতের মৃত্যু হবে এমন আশঙ্কা করছেন তারা।
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে আগে পর্যটক যাতায়াত ও সেখানে রাত যাপনে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে বছরের সাত মাস সেখানে দিনে প্রায় তিন হাজার পর্যটক যাতায়াত করতেন। এতে ব্যবসা হতো কয়েক শ’কোটি টাকার। কিন্তু বিগত সরকারের শেষ দিকে সেন্টমার্টিন যাতায়াতে বিধিনিষেধের উদ্যোগ আলোচিত হলেও তা আর শতভাগ কার্যকর হওয়ার আগের সরকারের পতন হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত বছরের অক্টোবর মাসে উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারলেও রাতে থাকতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গিয়ে রাতে থাকতে পারবেন। তবে শর্ত হলো, ওই দুই মাসে দৈনিক গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোনো পর্যটকই সেখানে যেতে পারবেন না। সরকারের ভাষ্য, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য, প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশ রক্ষায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এতে করে এ ব্যবসায় বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা। ফলে সম্ভাবনার এ খাত টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ নিয়ে তারা সরকারের সাথে দেনদরবার করলেও সরকার সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি।
বিগত এক বছরের চিত্র তুলে ধরে এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা যা আশঙ্কা করেছেন তাই হয়েছে। পর্যটন ব্যবসায় ভয়ানক ধস নেমেছে। প্রতি বছর দেশে ১০ লাখ করে পর্যটক বাড়লেও একদিকে যেমন সুযোগ সুবিধা বাড়ছে না, অন্য দিকে পর্যটনের সবচাইতে আকর্ষণীয় স্থান সেন্টমার্র্টিনে বিধিনিষেধে এ খাতের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
এ বিষয়ে সেন্টমাটিন রুটে জাহাজ ব্যবসায়ীদের অন্যতম নেতা ও সেন্টমার্টিনে হোটেল অবকাশের স্বত্বাধিকারী শিবলুল আজম কোরেশী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এতদিন সেন্টমার্টিনে মূলত বছরের অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ সাত মাস পর্যটক যাতায়াত করতেন। এ সময়ের মধ্যে সেখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় আড়াই হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটতো, যারা রাত্রিও যাপন করতেন। এতে করে জাহাজ ও হোটেল রিসোর্ট খাতে বছরে প্রায় পাঁচশ’ কোটি টাকার ব্যবসা হতো। এখন বড় জোর ১০০ কোটি হতে পারে।
কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সেখানে পর্যটকদের যাতায়াতে নিয়ন্ত্রণে আরোপ করা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটক যাতায়াত বন্ধই থাকবে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এ সভাপতি জানান, কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন তাদের মোট আটটি জাহাজ চলে। আর সেখানে হোটেল রিসোর্ট আছে দুই শতাধিক অধিক। এতে করে আগে বছরে ব্যবসা হতো পাঁচশ’ কোটি টাকার। আর বর্তমানে তিন মাসে মাত্র একশ’ কোটি টাকার ব্যবসা হলেও বছরে ক্ষতি গুনতে হবে চারশ’কোটি। এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাবনার এ খাতের মৃত্যু হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অপর দিকে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন (টোয়াব) সচিব নিজাম উদ্দিন ভূঁঁইয়া গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, মূলত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে পর্যটন মওসুম শুরু হয়। এ চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হয় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। কারণ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার একটি বিষয় থাকে।
ডিসেম্বরের মধ্যে সব স্কুলে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় এ সময়টা বেশি পর্যটক সমাগম হয়। এবারো তাই হবে। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেয়ায় বিড়ম্বনায় পড়ছেন আগতরা।
অন্য বছরের চেয়ে এবার পর্যটক বেশি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের ধারণা দেশব্যাপী এবার অর্ধকোটি পর্যটকের সমাগম হবে। তবে এদের সবাই অভ্যন্তরীণ। ফলে ব্যবসা হবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা; কিন্তু কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌরুটে পহেলা নভেম্বর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি থাকলেও, রাত্রি যাপনের অনুমতি না থাকায় এখান থেকে এখনো সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। এতে করে কয়েক শ’ কোটি টাকার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে পর্যটক বৃদ্ধির সাথে সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে কক্সবাজার হোটেল-গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০২৩ সালে অন্তত ৬০ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে এসেছেন। ২০২৪ সালে এসেছেন ৭০ লাখ, এ বছর তা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। বছরে ১০ লাখ করে তিন বছরে ৩০ লাখ পর্যটক বাড়লেও তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না।
তিনি বলেন, আগে সমুদ্রসৈকতে নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। নিরাপত্তার অজুহাতে এক দশক ধরে সবকিছু বন্ধ রয়েছে। এতে পর্যটকরা বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সিলেট, কুয়াকাটা, রাঙামাটি সুন্দরবনসহ একই অবস্থা অন্য স্থানগুলোতেও।



