বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন আর শুধুই সঙ্কটে নেই- এটি একটি সংগঠিত রাষ্ট্রীয় লুটপাটের পরিসংখ্যানগত প্রমাণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। মাত্র ছয় মাসে এই অঙ্ক বেড়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা- প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৫৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি আর সাধারণ ব্যাংকিং ব্যর্থতা নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, রাজনৈতিকভাবে সুরক্ষিত অর্থনৈতিক অপরাধের ফলাফল।
‘ঋণ’ নয়, এটি ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষিত লুটের লাইসেন্স : অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা কার্যত একটি লুটের যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। বিশেষত একটি গোষ্ঠী- এস আলম গ্রুপ- বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে তুলে নিয়েছে।
এই অর্থ উত্তোলন হয়েছে-
- ভুয়া জামানত
- কাগুজে প্রতিষ্ঠান
- রাজনৈতিক সুপারিশ
- বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কিছু কর্মকর্তার সরাসরি সহায়তায়
ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ‘এগুলো ঋণ নয়- রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে করা অর্থ পাচারের কভার স্টোরি।’
গোপন খেলাপির পাহাড় : বছরের পর বছর ভুয়া হিসাব : বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় দেখা যায়, বহু বছর ধরে বাস্তবে খেলাপি থাকা ঋণগুলোকে কৃত্রিমভাবে ‘মানসম্মত’ দেখানো হচ্ছিল। পুনঃতফসিলের নামে চালানো হয় একটি প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি ব্যবস্থা।
পরিসংখ্যানে সেই ভয়াবহতা
- ২০২৪ সালের ডিসেম্বর : ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা
- ২০২৫ সালের মার্চ : ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা
- ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর : ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা
মাত্র ৯ মাসে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা ‘নতুন’ খেলাপি- যা কার্যত পুরনো লুটপাটের বাস্তব চিত্র সামনে আসার ফল।
নতুন নীতিমালা : সত্য লুকানো আর সম্ভব নয়
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে ২০১২ সালের কঠোর ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা পুনর্বহাল করে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী
- কিস্তির সময়সীমা পার হলেই ঋণ ‘বকেয়া’
- ৩ মাস না দিলে সরাসরি ‘খেলাপি’
- আগের মতো রাজনৈতিক পুনঃতফসিলের সুযোগ কার্যত বন্ধ
ফলাফল- বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখা খেলাপির পাহাড় হঠাৎ হিসাবের খাতায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
প্রভিশন ঘাটতি : ব্যাংকগুলোর প্রকৃত দেউলিয়া চিত্র
খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস্তবতা হলো প্রভিশন ঘাটতি। সেপ্টেম্বর শেষে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে:
৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে যে নিরাপত্তা তহবিল থাকার কথা, তার বড় অংশই নেই। অর্থনীতিবিদরা একে বলছেন:
‘কাগজে ব্যাংক চলে। বাস্তবে বহু ব্যাংক ইতোমধ্যে দেউলিয়া।’
এর অর্থ:
- ব্যাংকের মূলধন কাঠামো ভেঙে পড়ছে
- আমানতকারীদের টাকা কার্যত ঝুঁকিতে
- সরকারের ওপর আসন্ন ‘বেইলআউট’ চাপ
কারা দায়ী : রাজনৈতিক ছায়ায় গড়ে ওঠা ব্যাংক ডাকাত চক্র
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই সঙ্কটের পেছনে কাজ করেছে একটি রাজনৈতিক-ব্যবসায়ী-আমলা সিন্ডিকেট। এরা-
- ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ দখল করেছিল
- বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ভূমিকাকে অকার্যকর করে রেখেছিল
- ঋণ খেলাপিদের ‘রাষ্ট্রের উন্নয়ন অংশীদার’ হিসেবে প্রজেক্ট করেছিল
এই চক্রের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হলে, বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সঙ্কট বারবার ফিরে আসবে।
অর্থনীতির সামনে টাইম বোমা
ব্যাংকিং খাতের এই ধসের প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান:
- নতুন শিল্পঋণ কার্যত স্থবির
- বড় বিনিয়োগ প্রকল্প স্থগিত
- বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত
- আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, ‘এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ একটি নীরব আর্থিক ধসের দিকে এগোবে।’
রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক উদ্ধার অসম্ভব
বিশেষজ্ঞদের একক মত:
* খেলাপি ঋণে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না হলে সমাধান অসম্ভব
* ব্যাংকিং খাতে বিশেষ আদালত ও ফাস্ট-ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি
* বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ সাংবিধানিক স্বাধীনতা দিতে হবে
* বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ওপর জনসম্মুখে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে
শেষ কথা : এটি শুধুই সংখ্যার গল্প নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের ব্যর্থতার দলিল। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে প্রশ্ন আর ‘সংস্কার হবে কি না’ নয়- প্রশ্ন হলো, ধসের আগে জাতি কতটা সত্য জানতে পারবে।



