ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রাষ্ট্র পরিচালনা মানব সমাজের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব। একটি রাষ্ট্রের উন্নতি, ন্যায়পরায়ণতা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপর। ইসলাম কেবল আধ্যাত্মিক জীবন নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ রাষ্ট্র পরিচালনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি মদিনায় ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন কিভাবে ন্যায়, সাম্য, শৃঙ্খলা, মানবাধিকার ও কল্যাণনির্ভর শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হলো ন্যায়বিচার। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন ন্যায়বিচার করতে, সৎকর্ম করতে এবং আত্মীয়কে সাহায্য করতে। (সূরা নাহল : ৯০)। নবী সা: তাঁর রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে এই কারণে যে, তারা বড় লোকদের অপরাধ ক্ষমা করত আর দুর্বলদের শাস্তি দিত। (বুখারি মুসলিম)। এ হাদিস থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, রাষ্ট্রে ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য ন্যায় সমানভাবে প্রযোজ্য।
পরামর্শ ও শুরার গুরুত্ব : রাষ্ট্র পরিচালনায় একক সিদ্ধান্ত নয়, বরং পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনে বলা হয়েছে, তাদের কাজ হলো পরামর্শের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। (সূরা শুরা : ৩৮)। নবী সা: রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহাবাদের সাথে নিয়মিত শুরা করেছেন। বদর, ওহুদ কিংবা খন্দকের যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে তিনি সাহাবাদের মতামত গ্রহণ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, শুরা-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা সুন্নাহর একটি মৌলিক দিক।
মানবাধিকার ও নাগরিক সুরক্ষা : নবী সা: মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করে মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার সুরক্ষিত করেছেন। তিনি বলেছেন যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে কষ্ট দিল, আমি তার বিরোধী হব কিয়ামতের দিন। (আবু দাউদ)। রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সম্মান বজায় রাখা সুন্নাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
জবাবদিহিতা ও নেতৃত্বের দায়িত্ব : নবী সা: বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রক্ষক, এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে (বুখারি, মুসলিম)। রাষ্ট্রপ্রধান শুধু ক্ষমতার মালিক নয়, বরং জনগণের সেবক। সুন্নাহ অনুসারে নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, জবাবদিহিতা ও আমানত রক্ষা করা।
দয়া, কল্যাণ ও সেবা : নবী সা: রাষ্ট্র পরিচালনায় দয়া ও কল্যাণকে সর্বাগ্রে রেখেছেন। তিনি জনগণের প্রতি সদয় ছিলেন, কখনো কঠোর শাসক ছিলেন না। তিনি বলেছেন ‘যে ব্যক্তি জনগণের সেবায় নিয়োজিত হবে, আল্লাহ তাকে রহম করবেন। (তিরমিযি)। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা।
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পরিহার : নবী সা: রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ঘুষ ও স্বজনপ্রীতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত হবে এবং তার ঘর ছাড়া অন্য কিছু নেবে, সে খেয়ানত করবে। (মুসলিম)। রাষ্ট্রে দুর্নীতি ও অপব্যবহার রোধ করা সুন্নাহ অনুসরণের আবশ্যিক অংশ।
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও নীতি-নিয়ম : নবী সা: প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, নিয়মিত নিরীক্ষা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি প্রশাসনকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতেন এবং দায়িত্বহীন বা অবাধ্য কর্মকর্তাদের তৎক্ষণাৎ সংশোধন করতেন।
শিক্ষা ও জ্ঞানোন্নয়ন : নবী সা: জনগণকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছেন। একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষা, বিচার ও নীতি-নিয়ম সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শান্তি ও সংঘর্ষ সমাধান : নবী সা: সামাজিক দ্বন্দ্ব মীমাংসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বদা উদ্যোগী ছিলেন। তিনি চুক্তি ও আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করতেন।
প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক উদ্ভাবন : যদিও নবীর সা: সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না, তবুও তিনি প্রশাসনিক কার্যকারিতা, তথ্য সংগ্রহ, জনসংখ্যা হিসাব এবং সম্পদ বণ্টনে যুগোপযোগী পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এটি আজকের ডিজিটাল প্রশাসনের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা : নবী সা: প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ছিলেন। জল, বন ও কৃষিজমি সঠিকভাবে ব্যবহার করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি টেকসই রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সামাজিক ন্যায় ও দারিদ্র্যবিমোচন : নবী সা: রাষ্ট্র পরিচালনায় দারিদ্র্য হ্রাস, জাকাত ও সদকা কার্যকরভাবে বিতরণের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় নবী সা:-এর সুন্নাহ শুধু ঐতিহাসিক দিক নয়, বরং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যও দিকনির্দেশনা। ন্যায়বিচার, শুরা, মানবাধিকার, দয়া, কল্যাণ, জবাবদিহিতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, শিক্ষা, শান্তি, সামাজিক ন্যায়, প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দারিদ্র্যবিমোচন- এসব মূলনীতি যেকোনো রাষ্ট্রকে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক



