নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শঙ্কা

রোববার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১১তম সভায় এই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সভাসূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

সারা দেশে খুন-চুরি, ডাকাতি-চাঁদাবাজি, ছিনতাই-সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালানসহ সবধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই অপরাধগুলোকে নির্মূলে ব্যর্থ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচন হলে সেই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল রোববার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১১তম সভায় এই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সভাসূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সভায় সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। এই ঘটনাগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঠিকভাবে এড্রেস করতে পারছে না। এরপর নির্বাচনের সময় ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

সভায় সরকারের আরেকজন উপদেষ্টা বলেন, রাজধানীর মিটফোর্ডে চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীকে নারকীয়ভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি নিজেই থানায় ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন; কিন্তু তার পরেও তাকে রক্ষা করা যায়নি। এটি কোনো ভালো উদাহরণ নয়। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মামলা থাকুক আর না থাকুক ভিডিও দেখে সংশ্লিষ্ট সবাইকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন।

সভায় সিলেটে পাথর উত্তোলনকে ঘিরে সৃষ্ট জটিলায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং এলাকায় অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন রাতের আঁধারে শত শত কার্গো দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলন করছে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ নারী ও শিশু নির্যাতনের একটি পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান।

সভায় সরকারের একটি বিশেষ সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে। তারা ছয় শত লোককে প্রশিক্ষণ দিয়ে একযোগে বোমা হামলার পরিকল্পনা করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইতোমধ্যে এই চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।

সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে মো: সোহাগ নামে এক ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটিকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণীতে (এফআইআর) উল্লিখিত ১৯ জনের মধ্যে ইতোমধ্যে সাতজনকে র‌্যাব, সেনাবাহিনীসহ পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

ঢাকার বাইরে গোয়েন্দাদল বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে বাকি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বুধবার সন্ধ্যায় ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে মঈন ও তারেককে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। গত শুক্রবার বিকেলে আরো দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তা ছাড়া শুক্রবার রাতেও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার রাতে এ ঘটনায় ডিবি আরো দুইজনকে গ্রেফতার করেছে। সবমিলিয়ে এ ঘটনায় এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ছয়জনকে ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রাজধানীর মিটফোর্ডে চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীকে নারকীয়ভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ দেশব্যাপী সাম্প্রতিককালে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে- এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বদ্ধপরিকর। এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অত্যন্ত তৎপর ও ঘটনা ঘটার সাথে সাথে অ্যাকশনে যাচ্ছে, অপরাধীদের গ্রেফতার করছে। তদন্তে আরো আসামি পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে ডিবির টিম সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ ঘটনায় প্রশাসনিক বা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কোনো শিথিলতা ছিল কি না তা সরকার গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখবে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে খুলনার হত্যাকাণ্ডের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকার এ মর্মে বিশ্বাস করে, অপরাধী অপরাধীই, তা সে যে দলেরই হোক না কেন। রাজনৈতিক অথবা অন্য কোনো পরিচয়ে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও দেয়া হবে না। কোনো অপরাধীকেই পুলিশ প্রশ্রয় দেবে না।

সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, নৈতিক স্খলন প্রভৃতি কারণে সমাজে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, দেশ ও সমাজ থেকে অপরাধ কমিয়ে আনার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পাশাপাশি আমাদের সবার। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, অভিভাবক, ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ জনতাসহ সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আর কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়- এ বিষয়ে জনসচেতনতা জরুরি। জননিরাপত্তা বিঘœকারী কোনো ঘটনা বা অপরাধ ঘটলে সেটি যেন যত দ্রুত সম্ভব আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে জানানো হয়। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন- খুন, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, অপহরণ, নারী নির্যাতন, মব সহিংসতা, মাদক চোরাচালানসহ সবধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যেকোনো সময় চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণসহ সবার সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। সরকার জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বিঘœকারী যেকোনো কার্যক্রম কঠোর হস্তে দমন করবে।