এস এম মিন্টু
- জড়িত প্রত্যেকের নাম উন্মোচন করে দেবো : ডিএমপি কমিশনার
- বিচারের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে অবরোধ
- ফয়সালের ২ সহযোগী ভারতে আটক
- ৭ জানুয়ারি চার্জশিট এ সরকারই বিচার কাজ শেষ করবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাওয়া শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নানা নাটকীয়তার পর প্রধান দুই সন্দেহভাজন শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল ও আলমগীর শেখ ভারতে পালিয়ে গেছে বলে স্বীকার করেছে পুলিশ।
পুলিশের ধারণা ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে ওসমান বিন হাদি খুবই ভোকাল ছিল, তার কথাবার্তা স্পষ্ট ছিল এবং একটি আদর্শকে ধারণ করে। এই আদর্শ বা ৫ আগস্টে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকতে পারে।
ফয়সাল করিমকে নিয়ে যাওয়া দুই সহযোগীকে ভারতের পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলেও জানায় পুলিশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনের গ্রেফতার ও ছয়জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার কথা জানানো হলেও চাঞ্চল্যকর ওসমান হাদিকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যমতে ওসমান হাদির দুই খুনি ফয়সাল ও আলমগীর বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে রয়েছে। এর নেপথ্যে আরো অনেকের নাম পাওয়া গেছে, তবে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করতে রাজি নয় পুলিশ।
এ দিকে গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে আদালতে। ২৬ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ শেষ হবে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বার্তা প্রত্যাখ্যান করে গতকাল ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা ঢাকাসহ আট বিভাগে সড়ক অবরোধ করে দ্রুত বিচার কাজ শেষ করার দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। তাদের দাবি ৩ দিনের মধ্যে চার্জশিট ও ১০ জানুয়ারির মধ্যে বিচার কাজ শেষ করতে হবে।
হাদির খুনিরা ভারতে পালিয়েছে : গতকাল রোববার ওসমান হাদি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো: নজরুল ইসলাম বলেছেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ফয়সাল করিম মাসুদ ও আলমগীর শেখ ভারতে পালিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ঘটনার দিনই হাদিকে গুলি করা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ ওরফে রাহুল ও মোটরসাইকেল চালক আলমগীর শেখকে শনাক্ত করা হয়। তাৎক্ষণিক তাদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম সাভার, হেমায়েতপুর, আগারগাঁও, নরসিংদীতে অভিযান পরিচালনা করে। ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে ডিএমপির একটি টিম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে।
এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এই ঘটনায় জব্দকৃত আলামতের মধ্যে রয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুইটি বিদেশী পিস্তল, ৫২ রাউন্ড গুলি, ম্যাগজিন, ছোড়া, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, ভুয়া নম্বরপ্লেট, হাদিকে বহনকারী অটোরিকশা, ৫৩টি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ২১৮ কোটি টাকার স্বাক্ষরিত চেক ইত্যাদি।
তিনি আরো বলেন, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, গ্রেফতারদের দেয়া জবানবন্দী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঘটনার পর পরই ফয়সাল ও আলমগীর ঢাকা থেকে সিএনজি করে আমিনবাজারে যায়। পরবর্তীতে সেখান থেকে মানিকগঞ্জের কালামপুর যায়। সেখান থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাইভেট কারে করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে পৌঁছে। আসামিদের চিহ্নিত করার আগেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। হালুয়াঘাটের আগে মুন ফিলিং স্টেশনে জনৈক ফিলিপ এবং সঞ্জয় তাদেরকে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ফিলিপ তাদের সীমান্ত পার করার পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জনৈক পুত্তির কাছে হস্তান্তর করে। পুত্তি ট্যাক্সি ড্রাইভার সামীর কাছে তাদের হস্তান্তর করে। সামী মেঘালয় রাজ্যের তুরা নামক জায়গায় তাদের পৌঁছে দেয়।
তিনি আরো বলেন, আমরা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে মেঘালয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, তারা ইতোমধ্যে পুত্তি ও সামীকে গ্রেফতার করেছে। আমরা সন্দেহ করি আসামিরা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এই ঘটনায় বিভিন্নভাবে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছয়জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এ ছাড়া চারজন সাক্ষী ১৬৪ ধারায় সাক্ষী দিয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি আমরা গুরুত্বের সাথে তদন্ত করছি। মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে আমরা চার্জশিট দিতে সক্ষম হবো।
হাদির হত্যাকারীরা পালিয়ে গেছে এটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেফতার করেছি, তাদের আমরা অভিযুক্তদের ছবি দেখিয়েছি। তাদের ভাষ্যমতে অভিযুক্তরা পালিয়ে গেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মূল আসামিকে গ্রেফতার করতে পারিনি। মূল আসামিকে গ্রেফতার করতে পারলে এর পেছনে কারা কিভাবে এ কাজ করেছে সেটা আরো স্পষ্ট হতো। আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে, কিন্তু তদন্তের স্বার্থে আমরা সেই নামগুলো বলবো না।
হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী জানতে চাইলে ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। এটা রাজনৈতিক কারণে হতে পারে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করছি না।
আসামিদের ফিরিয়ে আনতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি আছে। আমরা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠিক দুই ভাবেই তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই হাদি হত্যার বিচার সম্পন্ন : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, হাদি হত্যা মামলা চলাকালীন এ যাবত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতাররা হলো- ঘটনার মূল হোতা ফয়সাল করিম মাসুদের বাবা হুমায়ুন কবির, মা হাসি বেগম, স্ত্রী শাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু, বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, মো: কবির, নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, সিভিয়ন ডিউ, সঞ্জয় চিসিম, মো: আমিনুল ইসলাম রাজু ও মো: আব্দুল হান্নান।
তিনি বলেন, গ্রেফতারদের মধ্যে ছয়জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন এবং চারজন সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
তিনি আরো বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত রয়েছে তা উদঘাটনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে (৭ জানুয়ারি ২০২৬) এ মামলার চার্জশিট দেয়া সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জড়িত প্রত্যেকের নাম উন্মোচন করে দেবো : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যার পেছনে মূলে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা উন্মোচন করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো: সাজ্জাত আলী। গত শনিবার রাতে রাজধানীর শাহবাগে ইনকিলাব মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচিতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, এটি একটি রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড। এর পেছনে অনেকে জড়িত থাকার কথা। হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা জড়িত তা উদঘাটনে জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। হত্যাকাণ্ডের পেছনে-মূলে যারা রয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা উন্মোচিত করে দেবো।
তিনি বলেন, হাদিকে গুলির ঘটনায় যে দুটি পিস্তল ব্যবহার করা হয়, সে দুটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। পিস্তল দুটি সায়েন্টিফিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। যে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছে সেটি ডিবি পুলিশ উদ্ধার করেছে। এ সময় তথ্য ও সম্প্রচার; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উপস্থিত ছিলেন।
বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ : ওসমান হাদির খুনিদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল বেলা ২টার পর থেকে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে এ অবরোধ শুরু হয়। এর আগে শনিবার রাতে ইনকিলাব মঞ্চ আনুষ্ঠানিকভাবে এই সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয়। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, রোববার বেলা ২টায় শাহবাগ মোড়ে জুলাই স্তম্ভের নিচে জড়ো হওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টার মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা শাহবাগ এলাকায় আসতে শুরু করেন। তারা মোড়ের পাশের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন। বেলা আড়াইটার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা শাহবাগ মোড়ের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে মোড়ের মাঝখানে অবস্থান নেন। এতে শাহবাগসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। শাহবাগ মোড় থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন এবং শাহবাগ থেকে এলিফ্যান্ট রোড সব দিকের যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, শাহবাগ মোড়ের মাঝখানে বসে আছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। তারা একটু পরপর সেøাগান দিচ্ছেন। এ সময় ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘গোলামি না আজাদি, আজাদি আজাদি’, ‘যেই হাদি জনতার, সেই হাদি মরে না’, ‘হাদি না মোদি, হাদি হাদি’ এমন নানা সেøাগানে মুখর হয়ে ওঠে শাহবাগ এলাকা।
বিকেল ৩টায় হাদি হত্যার নিরপেক্ষ বিচারের দাবিতে তেজগাঁওয়ের সাত রাস্তায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তিন শতাধিক বিক্ষোভকারী রাস্তা বন্ধ করে দেন। এ সময় উভয় পাশের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই সময় উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ের উভয় পাশের রাস্তা বন্ধ করে অবরোধ করেন নেতাকর্মীরা। এ সময় চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। দীর্ঘ যানজটের কারণে এয়ারপোর্ট এলাকা পর্যন্ত যানবাহনের ভিড় বাড়ে।



