স্টাইল, শিল্প ও শৈশবের গল্প বললেন হীরা তারীন

সাকিবুল হাসান
Printed Edition
স্টাইল, শিল্প ও শৈশবের গল্প বললেন হীরা তারীন
স্টাইল, শিল্প ও শৈশবের গল্প বললেন হীরা তারীন

পাকিস্তানি অভিনেত্রী ও মডেল হীরা তারীন সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এলেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও ঘরোয়া পরিবেশে রেকর্ডকৃত পডকাস্টে। ‘পিক ফ্রান্স হার্টবিটস’ শিরোনামের এই পডকাস্টটি পরিচালনা করেন তার স্বামী, জনপ্রিয় অভিনেতা ও সঞ্চালক আলী সাফিনা। হাস্যরস, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও গঠনমূলক সমালোচনার সংমিশ্রণে এই পর্বটি ছিল অনেকটাই ব্যক্তিগত, আবার সমাজ-সচেতনও। এই আলাপচারিতায় হীরা তারীন কথা বলেন পাকিস্তানের মিডিয়া ও নাট্যজগত, নারীর উপস্থাপন, ব্যক্তিগত স্টাইল ও স্বকীয়তা এবং করাচিতে তার শৈশব নিয়ে, যা তাকে একজন শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে।

‘স্ত্রী মানেই ভয়ঙ্কর- এই ছকে বাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি কেন?’

আলোচনার সূচনায় হীরা মজা করে বলেন, অনেকেই তাকে বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘সানা সাফিনাজ’-এর সাথে গুলিয়ে ফেলেন, কারণ তার স্বামীর নাম সাফিনা। তিনি বলেন, ‘সবাই ভাবে আমি সবসময় রেগে থাকি। আমার স্বামী তো আমাকে একদম ভিলেন বানিয়ে ফেলে!’ এই স্নেহভরা অভিযোগের মাঝেই উঠে আসে একটি গভীর প্রশ্ন : ‘স্ত্রীদের কেন সবসময় রেগে থাকা বা কর্তৃত্বপরায়ণ হিসেবে তুলে ধরা হয়?’ একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা যা উপমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক বুননে গভীরভাবে প্রোথিত।

নাট্যশিল্পের বর্তমান ট্রেন্ড : সম্ভাবনার আলো ও চ্যালেঞ্জ

আলী সাফিনা জানতে চান, পাকিস্তানি নাট্যশিল্পে হীরার অভিজ্ঞতা কেমন এবং তিনি এই ইন্ডাস্ট্রিকে ‘সবুজ সঙ্কেত’ হিসেবে দেখেন কিনা। উত্তরে তারীন বলেন, ‘আমি বলব এটি সবুজ সঙ্কেত। তবে আরো সবুজ হতে পারে।’ তিনি জানান, পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে এক কাঠামোয় ফেলা যাবে না। ভালো কাজ যেমন হচ্ছে, তেমনি অনেক নাটক এখনো বিষাক্ত সম্পর্ক বা নারী নির্যাতনকে রোমান্টিক করে উপস্থাপন করছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সাম্প্রতিক বিতর্কিত নাটক মন মস্ত মলাঙ্গের, যেখানে প্রধান পুরুষ চরিত্র প্রেমিকাকে জোর করে বেঁধে রাখে। এ ধরনের উপস্থাপন সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণে ভূমিকা রাখে বলেও তিনি ইঙ্গিত দেন। তবে, তারীন আশাবাদী। তিনি উল্লেখ করেন তন মন নীল ও নীলের মতো নাটকের কথা, যেগুলো সমাজের অন্ধকার দিক- যেমন চরমপন্থা ও অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলছে। শিল্পের শক্তি ও দায়িত্ববোধ নিয়ে তার উপলব্ধি স্পষ্ট।

স্টাইল মানেই ট্রেন্ড নয়, স্টাইল মানে আত্মবিশ্বাস

সোশ্যাল মিডিয়ায় হীরা তারীন বরাবরই দৃশ্যমান এবং সমসাময়িক। কিন্তু নিজেকে ট্রেন্ড-অনুগামী বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘আমি যা আমার ওপর ভালো লাগে, সেটিই পরি। চিরন্তন স্টাইল আমাকে বেশি আকর্ষণ করে।’ তিনি জানান, আগে শুধু একরঙা পোশাক পরতেন, কিন্তু এখন প্রিন্টস ও নতুন ধাঁচে নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসেন। পরিবর্তনে বিশ্বাসী তারীন বলেন, ‘একই লুকে সারাজীবন থাকলে সেটি একঘেয়ে হয়ে যায়। মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত নিজেকে আবিষ্কার, পুনরাবিষ্কার আর নতুন করে সাজানো।’ তার বার্তাটি সহজ কিন্তু গভীর : ‘যেটিতে আপনি ভালো বোধ করেন, সেটিতেই আপনি সবচেয়ে সুন্দর দেখান।’

শৈশবের করাচি : শিল্পের বীজ রোপণের শহর

তারীন করাচিকে তার আত্মার শেকড় বলে উল্লেখ করেন। ‘আমার ব্যক্তিত্বের একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে করাচির মধ্য দিয়ে।’ তার পরিবারের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত সৃজনশীল। ‘আমাদের পরিবারে ছিল শিল্পী, ডাক্তার, এমনকি গায়ক। কিন্তু আমরা কেউই তখন তা গুরুত্ব দিয়ে নিইনি- আমিও না।’ নিজেকে শৈশবে লাজুক বললেও, তিনি জানান, তিনি ছিলেন একজন ধারালো পর্যবেক্ষক। এই পর্যবেক্ষণই পরে তার অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ‘অনেকে বলত আমি ট্যালেন্টেড, কিন্তু আমি ভাবতাম তারা শুধু আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে’, স্মৃতিচারণায় এক শিশুসুলভ সংশয়ও ধরা পড়ে।

‘সুপারপাওয়ার যদি চাইতেই হয়?’

আলাপচারিতার এক মজার জায়গায় সাফিনা প্রশ্ন করেন, ‘তোমার সুপারপাওয়ার কী?’

হীরা জবাব দেন, ‘আলোচনার ক্ষমতা বা আর্ট অব নেগোশিয়েশন’ এই ক্ষমতাটা থাকলে আমি আজ একজন ফিন্যান্সিয়াল ‘শার্ক’ হতে পারতাম।’ এই কথাতেই স্পষ্ট, হীরা তারীন শুধু একজন অভিনেত্রী নন; বরং একজন চিন্তাশীল নারী, যিনি নিজেকে আরো দক্ষ করে গড়ে তুলতে চান- বিশেষ করে জীবনের ব্যবহারিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলোয়।

শেষ কথা : শিল্পের ভেতর দিয়ে আত্মার খোঁজ

এই সাক্ষাৎকারে হীরা তারীন যেভাবে নিজের জীবন, কাজ, আত্মজিজ্ঞাসা এবং সমাজবোধ তুলে ধরেছেন, তা আজকের দক্ষিণ এশীয় নারী শিল্পীদের প্রতিচ্ছবি। একদিকে সাহস, অন্যদিকে সংবেদনশীলতা; একদিকে আত্মবিশ্বাস, অন্যদিকে আত্মসমালোচনার সাহস- এই দ্বৈততায় তিনি হয়ে উঠেছেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তি।

পডকাস্টটি শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়; বরং এক ধরনের চিন্তার অনুশীলনও বটে- যেখানে ব্যক্তি পরিচয়, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, শিল্পের দায়িত্ব এবং নারীর বাস্তবতা একে অপরের সাথে মিলেমিশে যায়।