ঘরের টাকা ফিরছে ব্যাংকে বাড়ছে আমানতপ্রবাহ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারো ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। মানুষ নিজের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা কমিয়ে ব্যাংকে টাকা রাখছে। এতে ব্যাংকবহির্ভূত আমানত কমে গেছে, বেড়েছে ব্যাংকে আমানতপ্রবাহ।

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

ব্যাংক লুটপাট ও আস্থাহীনতার কারণে মানুষ দুই বছর আগেও তার কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে রাখতে ভয় পেতেন। অনেকেই কষ্টার্জিত অর্থ নিজের কাছেই রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এ কারণে ব্যাংকে আমানতপ্রবাহ কমে গিয়েছিল। বেড়েছিল মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা। গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারো ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। মানুষ নিজের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা কমিয়ে ব্যাংকে টাকা রাখছে। এতে ব্যাংকবহির্ভূত আমানত কমে গেছে, বেড়েছে ব্যাংকে আমানতপ্রবাহ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গত বছরের জুনে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাত হাজার কোটি টাকা কমে নামে দুই লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তা আরো কমে হয় দুই লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুনে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ কমেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা।

এ দিকে ব্যাংকবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ কমে আসায় ব্যাংকে আমানতপ্রবাহ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এক বছরের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১০ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ছিল নৈরাজ্য। ব্যাংক পরিচালনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছ থেকে ব্যাংকের মালিকানা ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাংক ডাকাতদের কাছে ছেড়ে দেয়া, ঋণের নামে জনগণের আমানত হাতিয়ে নেয়া, নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা পাচার করে দেয়া, ঋণ পরিশোধ না করেও তা পরিশোধ দেখানো, দলীয় লোকদের ব্যাংকের মালিক বানানো ও তার মাধ্যমে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নেয়া ছিল অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। একমাত্র এস আলমের হাতে তুলে দেয়া হয় দেশের আটটি প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংক দখলে নেয়ার ব্যাংকগুলো থেকে পানির মতো টাকা বের করে নেয়া হয়। একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই টাকা বের করে নেয় এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখলে নিয়ে ঋণের নামে বের করে নেয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে শূন্য করে ফেলা হয়। একইভাবে আওয়ামী আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খ আলমগীর ফার্মার্স ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে জনগণের আমানত নামে-বেনামে বের করে নেন। ফলে ব্যাংকটি এক পর্যায়ে অস্তিত্বসঙ্কটে পড়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংকটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। ব্যাংকটির নতুন নাম রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক।

ব্যাংক ডাকাত এস আলম ও পি কে হালদার (বর্তমানে ভারতে আটক) রিলায়ান্স নামক আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান শূন্য করে ফেলে। বর্তমান ওই প্রতিষ্ঠানটির নাম বদল করে রাখা হয় আভিভা ফাইন্যান্স। সরকারি খাতের একটি ভালো প্রতিষ্ঠান ছিল বেসিক ব্যাংক। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় আব্দুল হাই বাচ্চুকে ওই ব্যাংকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

চেয়ারম্যান হয়েই বেসিক ব্যাংক থেকে দেদার টাকা বের করে নেয়া হয়। বর্তমান ব্যাংকটি রুগ্ণ ব্যাংক হিসেবে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। শিকদার পরিবারও টাকা বের করে নিতে কম যায়নি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে। এভাবে এ´িম ব্যাংক থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদার, আইএফআইসি ব্যাংক থেকে সালমান এফ রহমানও দেদার টাকা বের করে নেয়ায় ব্যাংকগুলো এখন রুগ্ণ ব্যাংকের খাতায় নাম লেখিয়েছে। এর ফলে বর্তমান এক্সিম, সোশ্যাল, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল- এই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে নতুন রূপে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এভাবে বেশির ভাগ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে রুগ্ণ করে ফেলা হয়েছে। বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান জনগণের আমানত ফেরত দিতে পারছে না।

এভাবে গত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এর প্রতিকারে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। উপরন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা লুটপাটের ¯্রােতের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। আর এ জন্যই মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দেয়। ঝুঁকি হলেও কষ্টার্জিত অর্থ নিজেদের হাতে রেখে দেয়। এভাবে ব্যাংকবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকিং খাতে প্রচণ্ড টাকার সঙ্কট দেখা দেয়। এ সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করা হয়।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর বিশেষ নজর দেয়া হয়। প্রথমেই বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর লুটেরাদের হাত থেকে ব্যাংকগুলো মুক্ত করেন। ১৩টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে। টাকা পাচার ঠেকাতে নেয়া হয় নানা ধরনের কর্মসূচি। এর ফলে মানুষের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা ফিরে আসে। নিজেদের কাছে টাকা রাখার প্রবণতা কমিয়ে ব্যাংকে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। গত ১৫ মাসে এভাবে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং খাতে ফিরে আসে। এতেই বেড়ে গেছে ব্যাংকের আমানতপ্রবাহ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকের টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত রাখতে সব ধরনের অনিয়ম দূর করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন আরো সুসংহত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকলুটেরা যাতে আর কখনো জনগণের আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেজন্য কঠোর আইন ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।