জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে তখন তার পরিবর্তে মোখলেস উর রহমানকে দুই বছরের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এই নিয়োগের পর জনপ্রশাসনে পদোন্নতি-পদায়নে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি হয়। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদায়নের অভিযোগ ওঠে। সেই সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের লাগাম টানতে জনপ্রশাসন সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর পরেও এ সব অভিযোগ অব্যাহত থাকায় গতকাল জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেয়া হলো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা মোখলেস উর রহমান। সার্ভিসে এই কর্মকর্তা সজ্জন এবং নীতিবান অফিসার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ায় দীর্ঘ ১৪ বছর পর তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন চাকরিতে নিয়মিত না থাকায় বর্তমান কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তার জানার সুযোগ ছিল না। সেই সুযোগে এই মন্ত্রণালয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যাদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয়। জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদায়ন না করার সিদ্ধান্ত থাকলেও অর্থের বিনিময়ে পদায়নের অভিযোগ ওঠে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এ সব ঘটনার তথ্য জনপ্রশাসন সচিবের কাছে গেলে সেই পদায়ন বাতিল করতেন তিনি। এইভাবে দীর্ঘ এক বছর টিকে থাকলেও অবশেষে তাকে সরিয়ে দিলো সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পদোন্নতি-পদায়নের জন্য জনপ্রশাসনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এই সিন্ডিকেটে জড়িতদের বেশির ভাগই আগে থেকেই জনপ্রশাসনে পদায়ন ছিলেন। এ ছাড়া শেখ হাসিনার সরকারের সুবিধাভোগী কয়েকজন কর্মকর্তা যারা সেই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এখন ভোল পাল্টে বিএনপিপন্থী বলে পরিচয় দিচ্ছেন এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন। সেই সিন্ডিকেটটি মূলত অফিসার্স ক্লাব কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ক্লাবের প্রভাবশালী একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে বদলির তদবির করেন। তাদের এই তদবির বাস্তবায়ন করাই প্রধান টার্গেট থাকে সিন্ডিকেটের। এর পর এ সব পদায়ন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে পদায়ন বাতিলের নির্দেশ দেন জনপ্রশাসন সচিব। এভাবে গত এক বছরে শতাধিক পদায়ন বাতিল করা হয়। এতে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন জনপ্রশাসন সচিব।
বাতিল করা হয়েছিল ৮ ডিসির নিয়োগ : গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর নিয়োগ দেয়ার পর বিভিন্ন অভিযোগে ৮ জেলার ডিসি পদে নিয়োগ বাতিল করা হয়েছিল। এরা হলেন- লক্ষ্মীপুরে নিয়োগ পাওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উপ-সচিব সুফিয়া আক্তার রুমী, জয়পুরহাটে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি ২-এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (উপ-সচিব) মো: সাইদুজ্জামান, কুষ্টিয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ফারহানা ইসলাম, রাজশাহীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো: মাহবুবুর রহমান, সিরাজগঞ্জে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মনির হোসেন হাওলাদার, শরীয়তপুরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব আব্দুল আজিজ, দিনাজপুরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোবাশশেরুল ইসলাম, রাজবাড়ীতে আরপিএটিসির উপ-পরিচালক মনোয়ারা বেগমকে ডিসি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
জনপ্রশাসনের শেষ দিনেও বিতর্কিত কর্মকর্তাকে ডিসি পদায়ন : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে নেয়ার দিন সকালে দেশের তিন জেলায় ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়। এতে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালকে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইনকে নরসিংদী এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মনিরা হককে নওগাঁর ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। তিনি স্বৈরাচারী শাসনামলে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আগে এই কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের ডিডিএলজি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব, পরিসংখ্যান বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন এর ভাই সৈয়দ নজরুল ইসলাম পলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক। শুক্রবার ছুটির দিনে ডিবি ও দুদক পরিচয়ে ‘রহস্যঘেরা’ অভিযান নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। তারা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে দরজার তালা ভেঙে বাসায় ঢোকে। আবার সকালে অভিযান শুরু করে সন্ধ্যায় সিআইডিকে যুক্ত করার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ। বিতর্কিত অভিযানের ঘটনার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম পলেনকে প্রধান কার্যালয় থেকে নওগাঁয় বদলি করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নওগাঁর ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল। বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
আব্দুল আওয়াল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলেন।
নওগাঁর ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মনিরা হক এর আগে পরিকল্পনা বিভাগে চার বছর কাজ করেছেন। এর আগে তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সময়ে তার মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব এবং উপ-সচিব হিসেবে চার বছরের বেশি সময় কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়াও ফেনীর এডিসি, পরশুরামের ইউএনও হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন এই কর্মকর্তা কর্মরত।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নওগাঁর ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল। বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। আব্দুল আওয়াল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলেন।