দুর্গাপূজা উপলক্ষে সর্বাত্মক নিরাপত্তা

কারাগারে জ্যামার লাগানোর নির্দেশ

জেল থেকে হাসিনার সাথে আলোচনা

গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে আয়োজিত সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাসিমুল গনি সভাপতিত্ব করেন।

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এসব ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছে কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। তারা কারাগারের অভ্যন্তরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দলীয় কর্মীদের অস্থিরতা তৈরিতে প্রভাবিত করছে। এমনকি পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের এমন কর্মকাণ্ড ঠেকাতে দেশের কারাগারগুলোতে জ্যামার লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে আয়োজিত সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাসিমুল গনি সভাপতিত্ব করেন।

সভায় সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ কমিশনার, পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন।

সভায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের সুবিধার্থে প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য পৃথক গেট নির্ধারণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়।

রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ : গত কয়েক দিনে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ-সঙ্ঘাত-উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের যমুনা অভিমুখে যাত্রা ঘিরে তাদের ওপর পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ, জলকামান ব্যবহার ও লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।

গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণ অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।

৩০ ও ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয়দের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ৩১ আগস্ট ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি সোমবার সকালের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল খালি করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হল না ছেড়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

এ ছাড়া ডাকসু, জাকসু, রাকসু ও চাকসু ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘিরেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাঠ প্রশাসনকে শক্ত অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি আরো সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দুর্গাপূজা উপলক্ষে সর্বাত্মক নিরাপত্তা : এ দিকে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে সর্বাত্মক নিরাপত্তা, সম্প্রীতি রক্ষায় কঠোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। দেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এসব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করা হবে। ২০২৪ সালে সারা দেশে ৩২ হাজার ৬৬৬টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ বছরও প্রায় সমপরিমাণ মণ্ডপে পূজা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এবার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে- প্রতিটি মণ্ডপে সিসি/আইপি ক্যামেরা স্থাপন ও ভিডিও ফুটেজ ইউএনও অফিস ও থানার সাথে সংযুক্ত থাকবে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে জরুরি সেবা ৯৯৯-এ বিশেষ টিম গঠন করা হবে। রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল থাকবে সার্বক্ষণিক। সীমান্ত ও উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ নজরদারি জোরদার করা হবে।

এর পাশাপাশি নারী ও শিশু দর্শণার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পৃথক প্রবেশ ও নির্গমন পথ এবং নারী স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে ফায়ার সার্ভিস ও ডুবুরিদল প্রস্তুত থাকবে, বিশেষত প্রতিমা বিসর্জনের সময়। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে বিদ্যুৎ বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, পাশাপাশি জেনারেটরের বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। যানজট এড়াতে রাজধানীর পুরান ঢাকা, নবাবপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবৈধ দোকান উচ্ছেদ ও পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে মসজিদ এলাকায় সম্প্রীতি রক্ষায় আজান ও নামাজের সময়ে মাইকের ব্যবহার বন্ধ রাখতে পূজা উদযাপন কমিটিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কড়া নজরদারি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটনাকারী বা সম্প্রীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বড় মণ্ডপগুলোতে পুলিশের বিশেষ টহল এবং র‌্যাবের নজরদারি থাকবে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কুমার দে বলেন, ‘দুর্গাপূজা সারা দেশের মানুষের উৎসব। সরকারের এ ধরনের প্রস্তুতি আমাদেরকে আশ্বস্ত করে। আমরা সবাই মিলেমিশে আনন্দ ও শান্তিপূর্ণভাবে পূজা সম্পন্ন করতে চাই।’

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের এক কর্মকর্তা জানান, ‘আমরা ইতোমধ্যে নিরাপত্তা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রতিটি পূজামণ্ডপকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত পুলিশ, গোয়েন্দা এবং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকবে।’

অন্য দিকে রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা কমিটির সদস্য সুভাষ চন্দ্র দত্ত বলেন, ‘শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, যানজট ও বিদ্যুৎ সমস্যাও আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারের প্রস্তুতি শুনে মনে হচ্ছে এবার পূজা নির্বিঘেœ হবে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সর্বাত্মক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতি সচেতনতা বজায় রাখলে এবারের দুর্গাপূজা হবে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল।