- নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে করে ৯৪% তরুণ
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্তুষ্ট ৫০% তরুণ
আগামী নির্বাচনে বিএনপি ৩৮.৭৬ শতাংশ, জামায়াত ২১.৪৫ শতাংশ, এনসিপি ১৬ শতাংশ ভোট পাবে বলে মনে করে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী। এর পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো পাবে ৪.৫৯ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি পাবে ৩.৭৭ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পাবে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট। ৫১ শতাংশ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার দেশে সোস্যাল হারমনি (সামাজিক ঐক্য) বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। ৫০ ভাগ তরুণ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্তুষ্ট। অন্যদিকে, আইনশৃখলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ৩৫ ভাগ তরুণ। ৯৪ ভাগ তরুণ আশাবাদী আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তবে তরুণরা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে হতাশ।
গতকাল সোমবার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ও অ্যাকশন এইডের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
‘ইউথ ইন ট্রানজিশন : ন্যাভিগেটিং জবস, এডুকেশন, অ্যান্ড চেঞ্জিং পলিটিক্যাল সিনারিও পোস্ট জুলাই মুভমেন্ট’ (‘যুবসমাজের পরিবর্তন : চাকরি, শিক্ষায় এবং জুলাই আন্দোলনের পর বদলানো রাজনৈতিক দৃশ্যপটে চলার পথ’ বা যুব জরিপ-২০২৫) শীর্ষক এই জরিপে অংশ নেয়া তরুণদের মধ্যে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ ছিলেন নিরপেক্ষ।
তারা কোনো মত দেননি। যুব জরিপ-২০২৫ শীর্ষক এই জরিপ প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাংক-ইন সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সানেম নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের নেতৃত্বে গবেষণা দল এই জরিপ পরিচালনা করেন। গবেষণা দলে আরো ছিলেন একরামুল হাসান, শাফা তাসনিম, এশরাত শারমিন, নীলাদ্রি নভিয়া নভেলি এবং মো: রজিব।
সানেমের জরিপে আরো উঠে এসেছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি পেলে আওয়ামী লীগ পাবে ১৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ ভোট।
সানেমের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আজ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সীমিত চাকরির সুযোগ, দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব, মানহীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব তাদের অগ্রযাত্রাকে বারবার ব্যাহত করছে। এসব বাধা শুধু তরুণদের ব্যক্তিগত উন্নয়নকেই থামিয়ে দিচ্ছে না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও পিছিয়ে দিচ্ছে। এই সঙ্কট ঘিরেই সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা দেখা গেছে। তরুণদের নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই অভ্যুত্থান মূলত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মহীনতার বিরুদ্ধে জমে ওঠা দীর্ঘদিনের ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
দেশের সব কয়টি বিভাগের ওপর চালানো এ জরিপে অংশ নেন ১৫-৩৫ বছর বয়সী দুই হাজার মানুষ। প্রথমে আট বিভাগ থেকে দু’টি করে জেলা বাছাই করা হয়। এরপর সেখান থেকে আবার দু’টি করে উপজেলা নির্বাচন করা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এসএসসির নিচে ৪০ শতাংশ, এসএসসি বা এর ওপরে ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে শহরের ছিল ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৫০ শতাংশ।
উল্লেখ্য, জরিপে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিএনপিকে, ২২.২১ শতাংশ জামায়াতে ইসলামীকে এবং ১৪.৪৪ শতাংশ এনসিপিকে ভোট দেয়ার কথা জানিয়েছেন। অপরদিকে, নারী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৭.০৩ শতাংশ বিএনপি, ২০.৫৭ শতাংশ জামায়াত এবং ১৭.৪৭ শতাংশ এনসিপিকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন।
অর্থাৎ জরিপ অনুযায়ী, এনসিপির প্রতি নারী ভোটারদের সমর্থন পুরুষ ভোটারদের তুলনায় কিছুটা বেশি।
জরিপে আরো দেখা গেছে, বিএনপিকে ভোট দেয়ার বিষয়ে গ্রামীণ অঞ্চলের ৩৭.৭২ শতাংশ এবং শহর অঞ্চলের ৩৯.৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জামায়াতের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন গ্রামে ২১.২৫ শতাংশ এবং শহরে ২১.৬৬ শতাংশ। এনসিপির ক্ষেত্রে এ হার গ্রামে ১৫.৩৮ শতাংশ এবং শহরে ১৬.২৮ শতাংশ।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার কথা বলেছেন গ্রামীণ অঞ্চলের ১৬.৬২ শতাংশ এবং শহর অঞ্চলের ১৩.৪৬ শতাংশ ভোটার। অর্থাৎ জরিপ অনুযায়ী, দলটির প্রতি গ্রামীণ ভোটারদের সমর্থন শহরের তুলনায় কিছুটা বেশি।
মব জাস্টিসের প্রভাব বাড়ছে, বলছে ৭১% তরুণ : সানেম জরিপ
জরিপে অংশ নেয়া অধিকাংশ তরুণই মনে করে দেশে ‘মব’ (সঙ্ঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) জাস্টিস অনেক বেড়েছে। দেশের ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ মনে করেন, মব জাস্টিসের ঘটনা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে এবং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে।
নারীবাদী বা উদারপন্থী মতাদর্শের প্রতি সামাজিক প্রতিক্রিয়া একটি উদ্বেগজনক ইস্যু হয়ে উঠছে বলে মনে করেন ৪৪.২ শতাংশ তরুণ, যেখানে ৩৫.২ শতাংশ নিরপেক্ষ ছিলেন। তবে এই জরিপে অংশ নেয়া তরুণদের মধ্যে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ ছিলেন নিরপেক্ষ। তারা কোনো মত দেননি। আর ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ মনে করেন দৈনন্দিন জীবনে মব জাস্টিস প্রভাব ফেলছে না।
সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা ইস্যু দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলছে, তা জানার জন্য জরিপে বিভিন্ন প্রশ্ন রাখা হয়। আগুন লাগানো, ডাকাতি ও চুরির মতো ঘটনার প্রসঙ্গে ৮০.২ শতাংশ উত্তরদাতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন; ১২.১ শতাংশ নিরপেক্ষ এবং ৭.৭ শতাংশ একমত নন।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার প্রভাব সম্পর্কে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিভক্ত: ৩৪.৫ শতাংশ এ ধরনের সহিংসতা দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন, ২৫.৭ শতাংশ নিরপেক্ষ এবং ৩৯.৯ শতাংশ একমত নন।
নারীবাদী বা উদারপন্থী মতাদর্শের প্রতি সামাজিক প্রতিক্রিয়া একটি উদ্বেগজনক ইস্যু হয়ে উঠছে বলে মনে করেন ৪৪.২ শতাংশ তরুণ, যেখানে ৩৫.২ শতাংশ নিরপেক্ষ ছিলেন।
সরকারি পরীক্ষার সময়সূচি নিয়ে হেরফের বা বিলম্ব প্রসঙ্গে ৩৭.৪ শতাংশ তরুণ একমত, ৪৫.৫ শতাংশ ছিলেন নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক সহিংসতা ও ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ৪৬.৭ শতাংশ উত্তরদাতা। আর রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট গ্রেফতার ও মামলার কারণে দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন ৫৬.২ শতাংশ।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলছে বলে মত দিয়েছেন ৫৩.৬ শতাংশ তরুণ, ২৮.২ শতাংশ নিরপেক্ষ এবং ১৮.৩ শতাংশ একমত নন।
৮৩ ভাগ তরুণ রাজনীতিতে অংশ নিতে চান না : জরিপে উল্লেখ করা হয়, ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ রাজনীতিতে অংশ নিতে চান না। মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী। রাজনীতিতে সহিংসতা আছে, আর এ কারণে ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ রাজনীতিতে অনাগ্রহী। এ ছাড়া ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ মনে করেন রাজনীতিতে দুর্নীতি ও আদর্শের ঘাটতি আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ তরুণ সরকারি চাকরিতে আগ্রহী আর ব্যবসায় আগ্রহী ২৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। ৪২ দশমিক ৩৪ শতাংশ তরুণ ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে অবগত নন।
৩৯ শতাংশ তরুণ দেশের রাজনীতির খোঁজখবর ও ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ তরুণ ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারে রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন। ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ দেশ ও বিদেশের খবর সংগ্রহ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে, ৪৭ দশমিক ৭ টেলিভিশন ও ১৩ শতাংশ খবর নেন পত্রিকা থেকে।
জরিপে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতা নিয়ে তরুণদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি স্পষ্ট। মাত্র ১১.৮২ শতাংশ মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা দেশের প্রকৃত সমস্যা প্রতিফলিত করে, যেখানে ৪৯.৪২ শতাংশ একেবারেই এ বিষয়ে একমত নন। অর্ধেক তরুণ (৫০.১ শতাংশ) মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাথে কোনো সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি, আর বিপরীতে মাত্র ১৬.১ শতাংশ তরুণ মনে করেন যে দলগুলো তরুণদের সাথে যুক্ত।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়েও তরুণদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। মাত্র ৩.৩ শতাংশ মনে করেন সংস্কার ছাড়াই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তবে ৫৬.৪ শতাংশ বিশ্বাস করেন, যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। অপরদিকে, ১১.৩ শতাংশ তরুণ ভবিষ্যতে পরিস্থিতির আরো অবনতি দেখছেন এবং ১৩.১ শতাংশ মনে করেন, কিছুই পরিবর্তন হবে না।
দেশের তরুণদের মধ্যে ৯৩.৯৬ শতাংশই আশাবাদী যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তবে ৬.০৪ শতাংশ ইতোমধ্যেই নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৭৬.৭৮ শতাংশ তরুণ, অন্যদিকে ৪.১৪ শতাংশ তরুণ ভোট দিতে অনাগ্রহী।