হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় সারা দেশে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে দলটির প্রায় এক হাজার ৫০০ প্রত্যাশী রয়েছেন। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি অক্টোবরের মাঝামাঝিতে কিংবা এ মাসের মধ্যে প্রার্থীদের বিজয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই করে প্রতিটি আসনে একজনকে সবুজ সঙ্কেত দেয়া হবে। যাদের তফসিলের পর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দলের মনোনয়ন বোর্ড চূড়ান্ত করবে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের মাঠে ডোর টু ডোর প্রচার-প্রচারণায় গতি আনতেই সুনির্দিষ্ট প্রার্থীকে সবুজ সফঙ্কত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের মতামতকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ের নেতারা কেন্দ্রকে জানিয়েছেন, নির্বাচনের মাঠে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল জামায়াতে ইসলামী আরো বহু আগে আসনভিত্তিক একক প্রার্থী চূড়ান্ত করে নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে আছে। ভোটকেন্দ্র ও ভোটার টার্গেট করে দলটি গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিটি আসনে বিএনপির একের অধিক প্রত্যাশী থাকায় সুনির্দিষ্টভাবে কেউই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারছে না। প্রচার-প্রচারণাও অনেকটা খাপছাড়া। জানা গেছে, মাঠপর্যায়ের এমন মতামত আমলে নিয়েই বিএনপির হাইকমান্ড শিগগিরই আসনভিত্তিক একক প্রার্থীকে সবুজ সঙ্কেত দেবে। এক্ষেত্রে যাতে কোনো গ্রুপিং কিংবা কোন্দল তৈরি না হয় সেজন্যও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা চলছে।
দলীয় উচ্চপদস্থ এক নেতা জানান, এবার বিএনপি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে তরুণ ও সুশিক্ষিত প্রার্থীদের ওপর যারা এলাকায় সক্রিয়, গ্রহণযোগ্য এবং জনগণের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। দল মনে করছে, আগামী নির্বাচনে ইমেজ ও মাঠভিত্তিক জনপ্রিয়তাই হবে নমিনেশনের প্রধান মাপকাঠি। প্রার্থী নির্বাচনে ‘ইলেকটেবলিটি’ অর্থাৎ জয়ের সম্ভাবনাকে প্রধান বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। সেই সাথে স্থানীয় জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক ভূমিকা ও দলের প্রতি আনুগত্যও গুরুত্ব পাচ্ছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘কোনো একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে আমরা আমাদের দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইব, যে ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন আছে, যার সাথে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, উঠাবসা আছে, যে ওই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। যে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, তরুণ, নারী, মুরুব্বিসহ ছাত্রছাত্রী সবার সাথে যার একটা কমিউনিকেশন আছে। এই ধরনের মানুষকেই আমরা প্রায়োরিটি দেবো। অর্থাৎ যার প্রতি জনসমর্থন আছে। যে জনসমর্থনকে তার সাথে রাখতে পারে। জনগণের যার প্রতি সমর্থন আছে সেরকম মানুষকে দেখেই আমরা নমিনেশন দেবো।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি যদি তরুণ ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেয়, তবে তা দলটির ভাবমূর্তিকে আরো ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রার্থীদের দৌড়-ঝাঁপ : প্রার্থিতা চূড়ান্ত না হলেও সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা এখন নতুন উদ্দীপনায় মাঠে নেমেছেন। প্রত্যাশীরা এলাকাভিত্তিক সভা, উন্নয়ন আলোচনা সভা ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় করছেন। কেউ কেউ সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করছেন, যেমন দরিদ্রদের সহায়তা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ বা স্থানীয় সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করছেন।
প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। নিজেদের কার্যক্রম তুলে ধরে দলীয় নেতৃত্বের নজর কাড়ার চেষ্টা করছেন। দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে প্রতিটি প্রত্যাশী স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে কাজ করছেন এবং নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার কৌশল নিয়েছেন। অনেকেই বিএনপির গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারে বিএনপির দীর্ঘ দিনের লড়াই সংগ্রাম ও জেল-জুলুমের কথা জনগণের কাছে তুলে ধরছেন।
ঢাকা-১১ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ড. এম এ কাইয়ুম বলেন, তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে উঠে এসেছি। জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি। দেশের বাইরে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হয়েছি। বাড্ডা-ভাটারা-রামপুরা আমার নিজের এলাকা। এই এলাকার জনগণের সাথে রয়েছে আমার নাড়ির সম্পর্ক। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ধানের শীষের পক্ষে জনসম্পৃক্ত নানা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে এই এলাকার উন্নয়নে নিজেকে আরো বেশি যুক্ত করতে পারব।
ঢাকা-৪ আসনে দলের মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবীন। তিনি বলেন, শ্যামপুর-কদমতলী আমার নির্বাচনী এলাকা। কেবল নির্বাচন সামনে রেখেই নয়, এই এলাকার জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে আমি ও আমার পরিবার সবসময় কাজ করে যাচ্ছি। আগামী দিনে দল আরো বেশি জনসম্পৃক্ত কাজ করার সুযোগ করে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী তরুণ নেতা শেখ সাদী বলেন, গত ১৭ বছর অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতি করতে হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী দিনে একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন। আমি সেই স্বপ্নের অংশীদার হতে চাই। দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, বিপুল ভোটে বিজয়ী হতে পারব বলে আত্মবিশ্বাস রয়েছে। রামপাল-মোংলার নির্বাচনী এলাকা (বাগেরহাট-৩) চষে বেড়াচ্ছেন পরিচ্ছন্ন নেতা ড. ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে রয়েছি। সার্বক্ষণিক নির্বাচনী এলাকায় রয়েছি। উঠোন বৈঠক, মতবিনিময় সভাসহ নানা জনসম্পৃক্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, দল আগামী নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দিয়ে এলাকার উন্নয়নে আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাদাত আহমেদ বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে ক্লিন ইমেজ ও বিজয়ী হতে পারে এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দেবেন। আমিও নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করেছি। এলাকার মানুষের পাশে রয়েছি। আগামী দিনেও তাদের পাশে থাকতে চাই।
সিলেট-৬ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ফয়সল আহমদ চৌধুরী বলেন, গোপালগঞ্জ-বিয়ানীবাজার এই আসনে ২০১৮ সালে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। মাত্র ২ ঘণ্টায় আমি লক্ষাধিক ভোট পেয়েছিলাম। কিন্তু স্বৈরাচার সরকার সারা দেশের মতো আমার আসনও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনেও দল থেকে আমি মনোনয়নপ্রত্যাশী। আমি বিশ্বাস করি জনগণের ভোট ও ভালোবাসাই রাজনীতির শক্তি।