জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করছে সরকার। এসব রদবদলে লঙ্ঘন করা হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদায়নের পরিপত্র। লটারির মাধ্যমে পদায়ন দাবি করা হলেও তার কোন প্রতিফলন নেই প্রজ্ঞাপনে। ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় পদায়ন হওয়া ২৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই সচিবালয়সহ ঢাকার মধ্যে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়াও ঢাকার আশপাশে লোভনীয় অনেক উপজেলায় পদায়ন করা হয়নি। আর লোভনীয় উপজেলাগুলো থেকে উঠিয়ে আনা কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা পরিপত্র অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনারদের হাতে। কিন্তু বুধবার ইউএনও বদলি ও পদায়নের পরিপত্র লঙ্ঘন করে সারা দেশে আট বিভাগে ১৬৬ কর্মকর্তাকে সরাসরি পদায়ন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এক দিনেই এ বদলি হওয়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
পদায়নের প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব মো: রিফাতুল হককে পদায়ন করা হয়েছে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মিজ মেশকাতুল জান্নাত রাবেয়াকে পদায়ন করা হয়েছে ফরিদপুর সদরে নেত্রকোনার সাবেক এমপি ও শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব সাজ্জাদুল হাসানের আত্মীয় পরিচয়ে এ কর্মকর্তা চাকরিতে যোগদানের পর থেকে গত সাত বছর ধরে ঢাকা বিভাগে কর্মরত।
পরিত্যক্ত সম্পদ ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মিজ রওশন জাহানকে পদায়ন করা হয়েছে ফরিদপুরের মধুখালীতে। এ কর্মকর্তা আওয়ামী শাসনামলে রমনা জোনের এসিল্যান্ড ছিলেন। আওয়ামী শাসনামলে রাজধানীর ডেমরা সার্কেলের এসিল্যান্ড থাকা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উপপ্রধান রিফাত নুর মৌসুমীকে পদায়ন করা হয়েছে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব আব্দুল্লাহ আল নোমান সরকারকে পদায়ন করা হয়েছে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায়।
পরিবেশ অধিদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জালাল উদ্দিনকে পদায়ন করা হয়েছে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায়। আওয়ামী শাসনামলে শেখ হাসিনার সচিব সালাহউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ থাকায় এ কর্মকর্তা কাজ করেছেন ক্যান্টনমেন্ট রাজস্ব সার্কেলে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব খান সালমান হাবীবকে পদায়ন করা হয়েছে ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় পদায়ন করা হয়েছে আওয়ামী শাসনামলে শিবালয়ের এসিল্যান্ড ও মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এসএম ফয়েজ উদ্দিন।
র্যাবের আইন কর্মকর্তা শাহ মো: জুবায়েরকে পদায়ন করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলায়। নরসিংদীর পলাশের সাবেক এসিল্যান্ড এ এইচ এম ফখরুল হোসাইনকে পদায়ন করা হয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায়। কেরাণীগঞ্জের সাবেক এসিল্যান্ড মিজ মনিষা রানী কর্মকারকে পদায়ন করা হয়েছে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কোটায় শেখ হাসিনার আমলে কেরাণীগঞ্জের এসিল্যান্ডের দায়িত্ব পাওয়া সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পদায়ন করা হয়েছে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলায়।
বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা ববি মিতুকে পদায়ন করা হয়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায়। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এস এম আব্দুল্লাহ বিন শফিককে পদায়ন করা হয়েছে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায়। হাওড় ও জলাভূমি অধিদফতরের উপপরিচালক লায়লা ইয়াসমিনকে পদায়ন করা হয়েছে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
শেখ হাসিনার আমলে টুঙ্গীপাড়ার এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক জহিরুল আলমকে পদায়ন করা হয়েছে একই উপজেলায়।
লটারিতে পদায়নের কথা বলা হলেও পদায়ন করা হয়নি গাজীপুরের সদর, শ্রীপুর, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায়।
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ এর কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ‘বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদ’ এর সদস্য সাভারের ইউএনও মাহবুবুর রহমানকে পদায়ন করা হয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। ধামরাইয়ের ইউএনও মামনুন আহমেদ অনীককে পদায়ন করা হয়েছে পরিকল্পনা বিভাগে, আড়াইহাজারের ইউএনও শেখ মামুনুর রশীদকে পদায়ন করা হয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, একসাথে অনেক কর্মকর্তা বদলি হওয়ায় তাদের কর্মস্থল সরাসরি নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কোনো অব্যবস্থাপনা না হয়। ঝুঁকিমুক্ত থাকার জন্য জনপ্রশাসন এভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রধান উপদেষ্টা লটারির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিভাগীয় কমিশনার জানান, জনপ্রশাসন কেন নিজেই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। আমাদের কিছুই জানায়নি। তবে আমাদের বিবেচনায় দিতে পারত।
গত বুধবার পৃথক ১০টি প্রজ্ঞাপনে ১৬৬ উপজেলায় নতুন ইউএনও নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রত্যাহার করে বিভিন্ন স্থানে পদায়ন করা হয়েছে ১৫৮ ইউএনওকে। সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে এসব নিয়োগ দেয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে ন্যস্ত করা কর্মকর্তাদের তাদের নিজ অধিক্ষেত্রে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর সেকশন-১৪৪ এর ক্ষমতা অর্পণ করা হলো।
গতকাল এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহছানুল হককে মোবাইলে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।



