২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ইতিহাসের এক অদ্বিতীয় মুহূর্তে বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত হয়েছিল নতুন ভূখণ্ড ১১১টি বিলুপ্ত ছিটমহল। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া ছিল তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ দিন দীর্ঘ ৬৮ বছরের রাষ্ট্রবিহীন জীবনের ইতি টেনে এ জনপদের মানুষরা রাষ্ট্রীয় পরিচয় পেয়েছে।
উপজেলার দাশিয়ার ছড়াসহ এসব এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হলেও এক দশক পরও অধরা রয়ে গেছে মৌলিক অধিকার ও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন।
নাগরিকত্ব, এনআইডি, ভোটাধিকার- সবই মিলেছে, তবু জীবনব্যবস্থায় পরিবর্তনের ছোঁয়া নেই। ছিটমহলবাসীর ভাষায়, ‘মানচিত্রে ঠাঁই হলেও বাস্তবে আমাদের কষ্টের ঠিকানা বদলায়নি।’
দাশিয়ার ছড়া ছিটমহল ঘুরে দেখা যায়, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক সড়ক, ব্রিজ ও সরকারি স্থাপনা। কিন্তু বাস্তবে এসবের অনেকটাই অকার্যকর বা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ হলেও সেখানে নেই কোনো প্রশিক্ষক, নেই কর্মসূচি- ভবনটি তালাবদ্ধ পড়ে রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। একইভাবে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হলেও নেই চিকিৎসক, নেই ওষুধ। সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে পাশের ইউনিয়ন বা উপজেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সরকারিভাবে চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত হলেও বাস্তবতা করুণ। অধিকাংশ বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ, কোথাও নেই শৌচাগার বা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। শিক্ষক সঙ্কটও প্রকট। স্থানীয় যুবক-যুবতীরা শিক্ষিত হলেও তাদের এমপিওভুক্ত স্কুলে নিয়োগ না হওয়ায় বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে।
১০ বছরেও ছিটমহলের মানুষের জন্য টেকসই কোনো কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দেখা যায়নি। কৃষির বাইরে বিকল্প কিছু নেই। নেই কারিগরি প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ বা সরকারি সহায়তা। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী চরম অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, “প্রতিশ্রুতি অনেক শুনেছি, বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই।”
ছিটমহলবাসীরা আজও পিছিয়ে রয়েছে ডিজিটাল সুবিধা থেকে। সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রম কিছু হলেও, তা বাস্তব সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট নয়।
দাশিয়ার ছড়ার বাসিন্দা আবদুল জলিল বলেন, “জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, ভোট দিই; কিন্তু এখনো আমাদের রাস্তা কাঁদায় ডুবে থাকে, স্কুলে শিক্ষক নেই, হাসপাতালে গেলে ওষুধ নেই।”
তিনি বলেন, ‘স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আমরা রাষ্ট্রের সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত।’
ছিটমহলবাসী আজ বাংলাদেশের নাগরিক হলেও, বাস্তবে তারা এখনো প্রান্তিক ও বঞ্চিত। উন্নয়নের কয়েকটি দৃষ্টান্ত থাকলেও মৌলিক চাহিদাগুলো রয়ে গেছে অপূর্ণ।
দশ বছরেও যদি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হয়- তবে স্বাধীনতার স্বাদ শুধু নথিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি ছিটমহলবাসীর একটাই আবেদন—“আমাদের কষ্টটা দেখুন, প্রতিশ্রুতি নয়, কাজ দিন।” মানচিত্রে ঠাঁই পেলেও, উন্নয়নের গন্তব্য যেন দাশিয়ার ছড়ার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছায়- এটাই এখন সময়ের দাবি।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, “সড়ক ও বিদ্যুৎ খাতে কিছু উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও অধিকাংশ উন্নয়ন আজও ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে আছে। প্রতিশ্রুতি অনেক দেয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। ভূমি জরিপ করা হলেও তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। বহু জমি ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছে, ফলে মানুষ এখন জমির মালিক হয়েও আইনগতভাবে নিজস্বতা প্রমাণ করতে পারছে না। এতে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।”
তিনি আরো বলেন, এক হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর আয়তনের সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়াকে তিন ভাগ করে ফুলবাড়ী সদর, ভাঙ্গামোড় ও কাশিপুর ইউনিয়নের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। “ছিটমহলটিকে একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের দাবি বহুদিনের। এতে প্রশাসনিক সেবা যেমন সহজ হবে, তেমনি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও গতি আসবে। কিন্তু এ দাবি আজও বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।”