শেয়ারবাজার সূচকের টানা পতনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে লেনদেনে। গতকাল মঙ্গলবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন নেমে আসে ৩০০ কোটির নিচে। এটি বাজারটির গত সাড়ে চার মাসের সর্বনিম্ন লেনদেন। গত বছরের ৮ ডিসেম্বরের পর ডিএসইর লেনদেন আর এ পর্যায়ে নামেনি। ওই দিন বাজারটি ২৮৭ কোটি টাকার লেনদেন নিষ্পত্তি করেছিল। গতকাল ডিএসইর লেনদেন ছিল ২৯১ কোটি টাকা। এর আগে গত ২৩ এপ্রিল ৩০০ কোটিতে নেমেছিল বাজারটির লেনদেন। তবে পরবর্তীতে তা আবার ৪০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারের সংস্কারকার্যক্রমের অংশ হিসেবে সম্প্রতি বিএসইসি কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তাই এ সময় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে কিছুটা দোদুল্যমান অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ফলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া টানা পতনে এ মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতাও শূন্যের কোঠায়। ব্যাংক ও বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে বেড়ে গেছে সুদের হার। এসব কারণে বাজারে তারল্য সঙ্কট বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ পুঁজিবাজারের চেয়ে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগেই স্বস্তি পাচ্ছেন।
তবে গতকাল লেনদেনের বেশি অবনতির কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন, গত সোমবার পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের মার্জিন রুলস ১৯৯৯ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সুপারিশ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে জমা দেন। সুপারিশে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমাতে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। গতকাল বাজারের লেনদেনে এ সুপারিশেরও কমবেশি ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এ দিকে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের মার্জিন রুলস ১৯৯৯ যুগোপযোগী করার চূড়ান্ত সুপারিশে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কেনাবেচা করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্তের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কেনাবেচা করতে হলে তাদেরকে ঋণ পরিচালনা করার সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে। এ ছাড়া প্রাথমিক বিনিয়োগে থাকতে হবে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা। থাকতে হবে নিয়মিত আয়ের উৎস যাতে বাজারের যেকোনো পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারী ঝুঁকি নেয়ার সামর্থ্য রাখেন। তা ছাড়া বিনিয়োগের ছয় মাসের আগে ঋণ পাবে না কোনো গ্রাহক। একইসাথে মিউচুয়াল ফান্ড এবং কোম্পানি হিসাবেও মার্জিন ঋণ দেয়া হবে না। চূড়ান্ত মার্জিন ঋণ নীতিমালায় এসব সুপারিশ করেছে পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি। আর সক্ষমতা প্রমাণের জন্য তাদের কাছে আয়কর সনদ, ব্যাংক স্টেটমেন্টের হালনাগাদ তথ্য ও ঋ.ণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান চাইতে পারে।
এ প্রসঙ্গে টাস্কফোর্স সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে। যার কারণ বাজার অচল অবস্থায় চলে গেছে। সে অবস্থাটাকে মাথায় রেখে আমরা চিন্তা করেছি, এর অন্যতম কারণ হলো মার্জিন রুলস। কারণ মার্জিন রুলসটা যদি প্লান করে দেয়া হতো, গভর্ন্যান্সটা যদি সঠিক থাকতো, তাহলে এ ধরনের অবস্থা তৈরি নাও হতে পারত। তাই মার্জিন রুলসকে আমরা টপ প্রায়োরিটি আইটেম ধরেছি। পৃথিবীতে মার্জিন রুলসকে শর্টটার্ম ওয়ে হিসেবে নেয়া হয়। কোথাও কোথাও ১:৩/৪ রেশিওতে মার্জিন ঋণ দেয়া হচ্ছে? এগুলা কিভাবে হয়েছে? এরপর বাজারে নেগেটিভ ইক্যুইটি ক্রিয়েট হয়েছে। আমরা চাচ্ছি এই জিনিসগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি বাজারে না হয়। মার্জিন নিয়ে আর গ্যামব্লিং করা যাবে না। মার্জিন নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এত পরিমাণ নেগেটিভ ইক্যুইটি না থাকলে বাজারের এই পরিস্থিতি হতো না।
টাস্কফোর্সের আরেক সদস্য হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এ এফ এম নেসার উদ্দীন বলেন, আমাদের কাজে সহযোগিতা করেছে ফোকাস গ্রুপ। মূল কাজ করেছে টাস্কফোর্স। আমরা কাজ করতে যেয়ে পাবলিকের কাছ থেকে অনেক পরামর্শ পেয়েছি। স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকেও পেয়েছি, তবে পাবলিক থেকে পরামর্শ বেশি এসেছে। এটা খুব ভালো বিষয়। কারণ যত বেশি পরামর্শ আসবে, আমরা তত বেশি রিফাইন করার সুযোগ পাবো।
বাজার পর্যালোচনা : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল ১৭ দশমিক ১৭ পয়েন্ট অবনতির শিকার হয়। চার হাজার ৯৫২ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট থেকে দিন শুরু করা সূচকটি গতকাল দিনশেষে নেমে আসে চার হাজার ৯৩৫ দশমিক ৬১ পয়েন্টে। ডিএসইর অপর দুই সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ হারায় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬১ ও ২ দশমিক ৯২ পয়েন্ট।
দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই এ দিন ৩০ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট হারায়। এখানে সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের অবনতি ঘটে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪২ ও ২১ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট।
ডিএসইতে গতকাল লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানিই দর হারায়। লেনদেনে অংশ নেয়া ৩৯৭টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১৩৬টির মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে দর হারায় ২১১টি। অপরিবর্তিত ছিল ৫০টির দর। তবে এ সময় লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানির মধ্যে দিনের শীর্ষে ছিল ব্যাংকিং খাতের কোম্পানি ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি। গতকাল ২৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় ৫৩ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার হাতবদল হয় কোম্পানিটির। ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় ২৪ লাখ ৫৪ হাজার শেয়ার বেচাকেনা করে বিচ হ্যাচারি ছিল দিনের দ্বিতীয় অবস্থানে। ডিএসইর লেনদেনে শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় আরো ছিল যথাক্রমে লাভেলো আইসক্রিম, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ইন্ট্রাকো সিএনজি রিফুয়েলিং, শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানি, এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ও শাইনপুকুর সিরামিকস।
দিনের মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষ কোম্পানি ছিল এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন। গতকাল ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ দাম বাড়ে কোম্পানিটির। এ ছাড়া প্রাইম ফিন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল ইউনাইটেড ফিন্যান্স, বিএসআরএম লিমিটেড, ডরিন পাওয়ার, ইন্ট্রাকো সিএনজি রিফুয়েলিং, রূপালি ব্যাংক ও ইস্টার্ন হাউজিং।