রাজস্ব বিভাগের ডিজিটাল রূপান্তরে বাণিজ্য ও করদাতার সুবিধা বাড়ছে

শাহ আলম নূর
Printed Edition

দেশের রাজস্ব বিভাগে পরিবর্তন আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর সুফল ইতোমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা বলছেন নতুন পদক্ষেপের কারণে করদাতা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গতি বেড়েছে। একই সাথে কর সংগ্রহেও কিছুটা উন্নতি এসেছে।

কর প্রশাসনে ডিজিটালাইজেশনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং এগুলো ধীরে ধীরে সুফল দিতে শুরু করেছে। করদাতা এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের কার্যক্রমে দ্রুততা এসেছে, সেই সাথে কর সংগ্রহেও কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এই অগ্রগতি এসেছে মূলত ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক ভার্চুয়াল অপারেশনে অগ্রসর হওয়ায় আগে যেখানে করের বিভিন্ন দফতরে কাগজপত্র নিয়ে টেবিল থেকে টেবিলে চলাফেরা করতে হতো, সেখানে এখন ডিজিটাল মাধ্যমে কর ফাইল ও ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন হচ্ছে, যা দুর্নীতির সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে এবং করদাতাদের আস্থা বাড়াচ্ছে।

ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য অনলাইন কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত অর্থবছরে (৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত) অনলাইনে কর রিটার্ন জমা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, কারণ কিছু পেশাজীবীর জন্য এটা বাধ্যতামূলক হয়েছে। গত ৪ আগস্ট থেকে দেশের সব ব্যক্তিগত করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ম্যানুয়ালি কর ফাইল অডিট নির্বাচনের প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। পুরনো ব্যবস্থায় করদাতাদের অডিট নির্বাচনের ম্যানুয়াল পদ্ধতি ছিল দুর্নীতির হাতিয়ার। এখন অডিটের জন্য ফাইল নির্বাচন সম্পূর্ণ ডিজিটাল এবং ঝুঁকিভিত্তিক পদ্ধতিতে হচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, কর রিটার্নের মাত্র ০.৫ শতাংশ ফাইল অডিটের জন্য বাছাই করা হয়, যা মোট ১৫ হাজার ৪৯৪টি ফাইল। অডিট বাছাই আরো উন্নত করার জন্য ঝুঁকিভিত্তিক অডিট নির্বাচন স্বয়ংক্রিয় করার পরিকল্পনা চলছে।

বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (বিএসডব্লিউ) গেটওয়ের মাধ্যমে আমদানির সনদ, লাইসেন্স ও অনুমতিগুলো অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। বিএসডব্লিউ চালু হওয়ার পর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে চার লাখ ৩১ হাজার ১৬৯টি অনুমতি ও লাইসেন্স পেয়েছে, যা পণ্য ছাড়পত্র প্রক্রিয়াকে দ্রুত করেছে। এই পদক্ষেপগুলো করদাতাদের ওপর হয়রানি কমিয়ে এবং কাস্টমসের পণ্য ছাড়পত্র প্রক্রিয়ার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের ফলে করকর্মকর্তাদের ও করদাতাদের মধ্যে গোপন লেনদেনের সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও ডিজিটালাইজেশনে অগ্রগতি হয়েছে, তবে মাঠের কর কর্মকর্তাদের মনোবল কম থাকার বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। চলতি বছর মে ও জুনে রাজস্ব প্রশাসনে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছিল যখন এনবিআরকে রাজস্ব প্রশাসন ও বাস্তবায়ন বিভাগের মধ্যে বিভক্ত করার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এতে কর কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক এবং হতাশা দেখা দিয়েছে।

একজন কর প্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, যন্ত্রের পেছনে যে মানুষ আছেন, তাদের মনোবল ও দক্ষতা না বাড়ালে ডিজিটালাইজেশন সম্পূর্ণ সফল হবে না। গত দশকে এনবিআর কর আদায়ের ক্ষেত্রে মাত্র ২.৫৬ শতাংশ বৃদ্ধির হার দেখিয়েছে, যা করোনার বছর বাদে সবচেয়ে কম। কর কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী উভয়ই আশাবাদী যদি সরকারের ট্যাক্স কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে বর্তমান অর্থবছরে কর আদায়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২৪ সালের অর্থবছর ছিল চ্যালেঞ্জপূর্ণ এবং কর সংগ্রহে সরাসরি প্রভাব পড়েছে। কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির বিকল্প নেই, কিন্তু কর বিভাগে সংস্কারে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। আগের ডিজিটালাইজেশন ছিল আংশিক। করদাতাদের এখনও কর অফিসে যেতে হয় কর প্রদান বা রিটার্ন জমার সময়।

বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদুল হাসান বাবু নয়া দিগন্তকে বলেন, অনলাইন কর রিটার্ন পদ্ধতিটি আরো উন্নত করা প্রয়োজন, কারণ বর্তমানে ফর্ম পূরণ করতে সময় বেশি লাগে। তিনি উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুরের করব্যবস্থা তুলে ধরেন, যেখানে কর কর্মকর্তারা করদাতার ব্যাংক হিসাব, সম্পত্তি, সিডিবিএল তথ্যসহ সব রেকর্ড দেখতে পান। এমন একটি সফটওয়্যার থাকা উচিত যা করদাতার দেয়া তথ্য যাচাই করে বড় অসঙ্গতি থাকলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তুলে ধরে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ডিজিটালাইজেশন ধাপে ধাপে সুফল দেবে। তারা এখন বিভিন্ন তথ্যের একীকরণ ও আন্তঃপরিচালনযোগ্যতার জন্য কাজ করছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, কিছুটা আংশিক স্বয়ংক্রিয়করণ এখনো বিদ্যমান। সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলোকেও ডিজিটালাইজেশনের একই গতি ধরে এগিয়ে যেতে হবে যাতে কর কর্মকর্তারা কর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্য সহজে পেতে পারেন।