সিন্ডিকেটের কবলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি খাত: ২

আইসিটিতে পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলার অভিযোগ

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাত দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের চক্রে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে- এমন অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় শুরু হওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প (সিবিএসএমপি) থেকেই শুরু হয় এই সিন্ডিকেটের তৎপরতা।

প্রভাবশালী ওই চক্রটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইসিটি নিয়ন্ত্রণে এনে ভবিষ্যতে দখলদারি ও আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা নেয়। সূত্র জানায়, এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল কার্যক্রমে স্থবিরতা, সাইবার নিরাপত্তা দুর্বল করা, দক্ষ জনবলকে অবমূল্যায়ন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের অনুগতদের বসানো।

সিন্ডিকেটের পরিকল্পনার সূচনা ও বাস্তবায়ন : প্রথম থেকেই আইসিটি বিভাগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং উন্নয়নের বদলে দিকভ্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ছিল এ সিন্ডিকেটের মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বর্তমান নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) দেবদুলাল রায়ের ভূমিকা। শুরুতে সিনিয়র সিস্টেমস এনালিস্ট থাকাকালেই তিনি পরিকল্পনায় সক্রিয় ছিলেন বলে দাবি করেছেন একাধিক কর্মকর্তা।

২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত, দক্ষতা নয় বরং আনুগত্যের ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ ও পদায়নের অভিযোগও উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংক্রান্ত কাজে মেইনটেন্যান্স অভিজ্ঞদের বদলে প্রোগ্রামিং ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়।

রিজার্ভ চুরি ও আইসিটির দুর্বলতা : ২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরির পেছনেও আইসিটি বিভাগে দক্ষ লোকের অভাব ও নজরদারির ঘাটতিকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সাইবার নিরাপত্তায় তেমন প্রস্তুতি ছিল না, যা এই চুরির অন্যতম কারণ।

সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ : ২০১৭ সালে ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আইসিটি বিভাগের কাজ বিভাজন করে দু’টি ইউনিট গঠন করা হয় : আইএসডিএসডি (সফটওয়্যার উন্নয়ন) ও আইসিটিআইএমএমডি (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবস্থাপনা)।

এই কাঠামো কিছুটা স্থিতি আনলেও, সিন্ডিকেট তা পুনরায় দখলের পরিকল্পনা নেয়। ২০২১ সালে একটি ‘পুনর্গঠন টিম’ গঠন করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংক্রান্ত কাজ আলাদা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়, যা অনেকের মতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

২০২৩ সালের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও গভর্নরের ভূমিকা : সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে এই দু’টি বিভাগ আবার একীভূত করে দেবদুলাল রায়ের নেতৃত্বে আনা হয়, যার ফলে অ্যাপ্লিকেশন ও ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একীভূত হয়ে সাইবার নিরাপত্তায় মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়।

অভিযোগ রয়েছে, গভর্নর তালুকদার ছিলেন এ সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষক, যার ফলে রিজার্ভ চুরির পর গৃহীত কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন ছাড়াই ভেঙে ফেলা হয়।

দুর্নীতির অভিযোগ ও তথ্য পাচারের শঙ্কা : এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিনিময়ে নিয়ন্ত্রণ নেয়া, তথ্য পাচার এবং দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিপন্ন করার অভিযোগ রয়েছে। আইসিটির গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট যেমন সিআইএসও ও সিএ ইউনিট নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়।

বিশেষ তদন্ত ও জবাবদিহিতার দাবি : সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, হিউম্যান রিসোর্স বিভাগ থেকে অনুমোদন ছাড়াই কেন পুনর্গঠিত টিম কাজ বন্ধ করে দেয় এবং তারা কিভাবে এত শক্তি অর্জন করে তা তদন্ত হওয়া জরুরি। একই সাথে এই সিন্ডিকেট কিভাবে সফটওয়্যার বিভাগের ছত্রছায়ায় ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়, সেই প্রশ্নও এখন তদন্তসাপেক্ষ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সংবেদনশীল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইসিটি বিভাগের ওপর এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত হস্তক্ষেপ শুধুই নীতিহীনতার পরিচায়ক নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত এবং দায়ীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা উচিত।