জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান

জুলাইযোদ্ধাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ

Printed Edition
সংসদ ভবনের সামনে জুলাইযোদ্ধাদের ওপর পুলিশের অ্যাকশন : নয়া দিগন্ত
সংসদ ভবনের সামনে জুলাইযোদ্ধাদের ওপর পুলিশের অ্যাকশন : নয়া দিগন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঐতিহাসিক জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দেওয়াল টপকে ঢুকে পড়ে ‘জুলাইযোদ্ধারা’। পরে তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় বিক্ষুব্ধ জুলাইযোদ্ধাদের সাথে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশের গাড়িসহ একাধিক গাড়ি ভাঙচুর ও দর্শনার্থীদের প্যান্ডেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার পর সংসদ ভবন এলাকাসহ আশপাশের রাস্তায় সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং দোকানপাট সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার মো: শহীদুল্লাহ বলেন, পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও হামলা করা হয়েছে। পুলিশের পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন। এ ঘটনায় কয়েকজন আটক রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে পরিচয় জেনে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিক্ষুব্ধ জুলাইযোদ্ধারা পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে জাতীয় সংসদ এলাকায় অবস্থান নেন। সনদে অবমূল্যায়ন, স্বীকৃতি না দেয়া এবং আইনি ভিত্তি না থাকার অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।

পুলিশ তাদের সরিয়ে দিলেও শতাধিক লোক পুনরায় মঞ্চের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে মঞ্চের সামনে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগ একই রঙের পোশাক পরেছিলেন। এ সময় পুলিশ আবার তাদের সরিয়ে দেয়। বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে খামারবাড়ি মোড়ের দিকে, আরেকটি দলকে আসাদ গেট প্রান্তের দিকে সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খামারবাড়ি মোড়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয় বিক্ষোভকারীরা। তারা পুলিশের এক সদস্যকে মারধর ও পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করে।

জানা গেছে, পাঁচ শতাধিক বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারী নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার মূল মঞ্চ এবং অতিথিদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে পড়েন। বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, সনদ প্রণয়নে তাদের পরামর্শ নেয়নি সরকার। একই সাথে স্বীকৃতি না দিয়ে করা হয়েছে অবমূল্যায়ন। ঘোষণাপত্রের মতো এখানেও আইনি ভিত্তি না থাকার অভিযোগ তাদের। বেলা ১টার দিকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত হন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজসহ কমিশনের সদস্যরা। এ সময় হত্যার বিচার, জুলাইযোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সম্মান, আর্থিক সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে আশ্বস্ত করেন আলী রীয়াজ। তবে আলী রীয়াজের বক্তব্যেও আশ্বস্ত হতে পারেননি জুলাই যোদ্ধারা। এরপরই তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন। বিকেল ৪টায় শুরু হয় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান।

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সংগঠক মো: মুনতাসিব ফুয়াদ বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেও জুলাই যোদ্ধারা ঐকমত্য কমিশনের সাথে কথা বলেছে, তখন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে এখন আর কিছুই করার নেই। পরে জুলাইযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ জুলাই সনদ যদি জুলাইযোদ্ধাদের মনোপুত না হয়, তাহলে এটি বাস্তবায়নের কোনো মানে নেই। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ (শুক্রবার) এখানে অবস্থান নেয়ার পর যেটি ঘটেছে সেটি দুঃখজনক। কারণ যাদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত, তাদেরকে মারধর করা হয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক।

আন্দোলনকারী শামীম হাসান বলেন, শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়াকড়ি অবস্থানে থাকলে আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারতাম না। আমাদের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে, পরে পেটানো হলো। আমরা আইন ভাঙার পক্ষে না। তবে যেটি করা হয়েছে, সেটি মেনে নেয়ার মতো না। জুলাইযোদ্ধা আজমী ফেরদৌস বলেন, সংবিধানে জুলাইযোদ্ধাদের স্বীকৃতি না আসলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব।

এ দিকে গতকাল সন্ধ্যার পর খামারবাড়ি থেকে শতাধিক জুলাইযোদ্ধা মিছিল নিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ গেটের দিকে যেতে থাকে। এ সময় অবৈধ জুলাই সনদ মানি না, মানব না; আমার ভাইয়ের গায়ে হামলা কেন, জবাব চাই জবাব চাই; ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছিল তারা। পরে তারা সংসদ ভবনের দক্ষিণ গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে এসব স্লোগান দিতে থাকেন।

ঢামেকে আহত ২০ জুলাইযোদ্ধা : জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের ঘটনায় অন্তত ২০ জন আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আহতরা হলেন- আতিকুল গাজী, সাইফুল ইসলাম, লাইলী আক্তার, কামরুল হাসান, শরিফুল ইসলাম, সিনথিয়া, আশরাফুল, হাবিবউল্লাহ, শফিউল্লাহ, শাকিব, মো: লিটন, তানভীর, দুলাল, কামাল, ওমর ফারুক, নুরুল হুদা, আখের উদ্দিন, মিজান, মোস্তাক বিপ্লব ও আল আমিন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো: ফারুক বলেন, আহতদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়।

আহতদের মধ্যে একজন জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে ডান হাত হারানো আতিকুল গাজী বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেয়ার প্রতিবাদে আমরা জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধারা আন্দোলন করে আসছিলাম। সরকার আমাদের দাবিতে সাড়া না দিয়ে আজ জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান করতে গেলে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদে দাঁড়াই। তখন হঠাৎ পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।

পুলিশের চার সদস্য আহত : ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো: জিল্লুর রহমান বলেন, নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের চার সদস্য আহত হয়েছেন। তারা হলেন, টিআই মাহাবুব শাহ, সার্জেন্ট মো: জিয়াউল হক, টিএসআই অজিউল্ল্যাহ। তারা মানিক মিয়া এভিনিউতে দায়িত্বে ছিলেন। কনস্টেবল ইব্রাহিম ছিলেন ধানমন্ডি গভ: বয়েজ-১ এ। তিনি বলেন, গতকাল বেলা পৌনে ২টায় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পুলিশ ছত্রভঙ্গ করার সময় তারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ওপর লাঠি ও কিল ঘুষি দিয়ে হামলা করেন এবং বিভিন্ন গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটান।