জলবায়ু পরিবর্তন

নিরপরাধ হয়েও বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ

আবুল কালাম
Printed Edition

জলবায়ু পরিবর্তনে নিরপরাধ হয়েও বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কার্বন নির্গমনে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ নামমাত্র হলেও প্রতিনিয়ত দেশটি সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ ও বিপদাপন্ন হচ্ছে। এতে বিশ্বে চরম ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ দেশের তালিকায় বারবার উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘নেট জিরো’ নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে বিরাজমান অবস্থায় বিশ্বকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বাস্তবতার আলোকে সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশের প্রায় ১ ভাগ মানুষ যে পরিমাণ কার্বন নির্গমণ করে সেই পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে বিশ্বের ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ। সেদিক থেকে বাংলাদেশের কার্বন নির্গমনের পরিমাণ খুবই নগণ্য। তার পরও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিপদাপন্ন হওয়ার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য বিদ্যমান যে বরাদ্দ রয়েছে, বাংলাদেশের জন্য তার থেকে অনেক বেশি অর্থায়ন প্রয়োজন। আর চলমান সমস্যা সমাধানে উন্নত দেশগুলো ‘নেট জিরো’র প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তাবায়নে তাদের ভূমিকাও পরিষ্কার করতে হবে।

জার্মান ওয়াচ গোাবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন বাস্তুচ্যুত হয়ে ‘ক্লাইমেট রিফিউজিতে পরিণত হতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯ দশমিক ৬ ইঞ্চি বা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ প্রায় ১১ শতাংশ ভূমি হারাতে পারে এবং এ প্রক্রিয়ায় প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। অপর দিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআর,বি বলছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড, বৈশ্বিক উষ্ণতা, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে ভেক্টর বাহিত রোগ, ভাপ-প্রবাহ, তাপমাত্রার চাপ, বায়ু দূষণ এবং খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ও প্রকল্প প্রধান ড. পিটার কিম বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি। এর ফলে যেসব নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বে পড়বে তার সবকিছুই বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এতে করে পাশের বেশ কিছু অঞ্চল নিকট ভবিষ্যতে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। এর কারণে লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পকারখানায় পণ্য ও কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে।

এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত এক দশকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমনের হার বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে গ্রীষ্মকালে ফসলের চাষাবাদ বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করা মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সবসময় দুর্যোগপ্রবণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ভুক্তভোগীদের অন্যতম বাংলাদেশ।

ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, কার্বন নিঃসরণে দেশগুলো যে পরিমাণের কথা বলছে বাস্তবে তার পরিমাণ বছরে ১৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন বেশি। এই পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাতে গেলে বিশ্বের ৩০০ কোটি গাড়ি চলাচল বন্ধ ও চার বিলিয়ন একর নতুন বনভূমি সৃজন করতে হবে। অর্থাত বর্তমানে পৃথিবীতে যে পরিমাণ চাষযোগ্য জমি আছে তার সবটাই প্রয়োজন। এক কথায় কার্বন নিরপেক্ষকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পৃথিবীর মতো আরেকটি পৃথিবী লাগবে। যা অবাস্তব ও অসম্ভব। সুতরাং চলমান সমস্যা সমাধানে বাস্তবতার আলোকেই বিশ্বকে সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

অন্য দিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশ মাত্র দশমিক ০ চার ১ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যা দেশের লোক সংখ্যার তুলনায় খবুই ন্যায্য। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রগুলো যে পর্যায়ে কার্বন নিঃসরণ করে আজকে উন্নত হয়েছে সেগুলো খুবই উদ্বেগজনক। সার্বিকভাবে বলা যায় বৈশিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ কোনোভাবে দায়ী না হয়েও পৃথিবীর সবচাইতে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। যার জন্য অবশ্যই উন্নত রাষ্ট্রগুলো বেশি দায়ী।

তার ভাষ্য, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো দূষণের শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশের মতো তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। তার পরও জাতিসঙ্ঘের হিসেবে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাতটি রাষ্ট্রের একটি হলো বাংলাদেশ। অথচ দূষণের এক হাজার ভাগের এক ভাগের জন্যও বাংলাদেশ দায়ী নয়। সে হিসাবে নিরাপদ হয়েও বিশ্বে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হলো বাংলাদেশ।