বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত মিললেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প ঋণ, শেয়ারবাজার ও বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মিশ্র চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ‘সাপ্তাহিক অর্থনৈতিক সূচক (৩০ অক্টোবর ২০২৫)’ অনুযায়ী, রিজার্ভে সামান্য বৃদ্ধি দেখা গেলেও বিনিয়োগে স্থবিরতা ও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এখনো প্রবল।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সামান্য উন্নতি : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অক্টোবর শেষে দাঁড়িয়েছে ২৭.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বিপিএম৬), যা জুনের ২৬.৫৪ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় কিছুটা বেশি। যদিও রিজার্ভ এখনো ২০২৩ সালের ৩১ বিলিয়ন ডলার পর্যায়ের নিচে রয়েছে।
রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৩০.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ২৬.৮৩ শতাংশ বেশি।
রফতানি বাড়লেও আমদানি প্রায় স্থিতিশীল : ২০২৫ অর্থবছরে রফতানি আয় (এফওবি) দাঁড়িয়েছে ৪৩.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৭.৭২ শতাংশ বৃদ্ধি। অপর দিকে আমদানি ব্যয় (সিঅ্যান্ডএফ) হয়েছে ৬৮.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২.৪৪ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয়ের এই সামঞ্জস্য চলতি হিসাবের ঘাটতি কমাতে সহায়ক হলেও শিল্প উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধীরগতির ইঙ্গিত দেয়।
টাকার মান কমেছে, সুদের হার কিছুটা স্থিতিশীল : অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত ইন্টারব্যাংক মার্কিন ডলার বিনিময় হার গড়ে ১২২.৭৭ টাকা, যা গত বছরের ১২০ টাকার তুলনায় টাকার প্রায় ২ শতাংশ অবমূল্যায়ন নির্দেশ করে। অপর দিকে কল মানি রেট (একদিন মেয়াদি আন্তঃব্যাংক ঋণের হার) এবং ওজনকৃত গড় সুদের হার সামান্য বেড়েছে, যা অর্থবাজারে তারল্য সঙ্কটের ইঙ্গিত দেয়।
শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত : অক্টোবর শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক কমেছে ৩.০৭ শতাংশ, আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) পতন ৪.৭৭ শতাংশ।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, উচ্চ সুদের হার ও শিল্পখাতের অনিশ্চয়তা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের রেকর্ড বৃদ্ধি : ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ বেশি।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো, নেট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশে, যা ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বড় চাপ সৃষ্টি করছে।
কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ খাতে ঋণপ্রবাহে উন্নতি : চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে কৃষি ও গ্রামীণ ঋণ বিতরণ হয়েছে প্রায় ৪,৮২৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় বেশি। একই সময় এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে কিছুটা গতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (প্রাক্কলিত) মাত্র ৩.৯৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের ৪.২২ শতাংশেরও নিচে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রফতানি প্রবৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় ইতিবাচক হলেও বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ঋণখেলাপি বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতির গতি মন্তর।
বিশ্লেষণ : পুনরুদ্ধারের পথে এখনো অনিশ্চয়তা : অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু শিল্প ও ব্যাংক খাতে কাঠামোগত সংস্কার না হলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন সমন্বিত নীতিগত উদ্যোগ নেয়া দরকার।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, ২০২৬ অর্থবছরে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছোঁয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি কমাতে রফতানি প্রণোদনা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি কর্মসূচি চালু থাকবে।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে এগোলেও এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে খেলাপি ঋণের বোঝা, বিনিয়োগের মন্দাভাব ও প্রবৃদ্ধির মন্তর গতি।
 


