ডিসি হতে তোড়জোড় শায়লার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তার

ডিসি নিয়োগে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী বা বিতর্কিত কর্মকর্তাকে স্থান না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেটি উপেক্ষা করে কৌশলে ডিসি হতে তোড়জোড় চালাচ্ছেন বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া বিতর্কিত শায়লার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা।

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খুব শিগগিরই দেশের সব জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে নতুন ফিটলিস্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার শেষে প্রায় এক শ কর্মকর্তাকে ফিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডিসি নিয়োগে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী বা বিতর্কিত কর্মকর্তাকে স্থান না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেটি উপেক্ষা করে কৌশলে ডিসি হতে তোড়জোড় চালাচ্ছেন বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া বিতর্কিত শায়লার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিল বহুল আলোচিত ৫ আগস্টের পরে পালিয়ে যাওয়া পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলামের স্ত্রী ও অতিরিক্ত সচিব শায়লা ফারজানা। ৫ আগস্টের পরে কর্মচারীদের তোপের মুখে শায়লা ফারজানা জনপ্রশাসনে টিকতে না পারলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় অন্তর্বর্তী সরকার। এই ঘটনার এক বছর পার হয়ে গেলেও এখনো তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা জনপ্রশাসনে বহাল রয়েছেন। এমনকি জেলা প্রশাসক পদায়নের জন্যও জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তার রেখে যাওয়া ঘনিষ্ঠ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৮ ব্যাচের উপসচিব মো: তৌহিদ বিন হাসান।

এই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০ সালে আওয়ামী শাসনামলে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তৌহিদ বিন হাসান। এক বছর সেখানে চাকরি করার পর চলে আসেন গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার হিসেবে। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার এসিল্যান্ড হিসেবে। সেখানে ৪ মাস চাকরি করে পদায়ন নেন ঢাকার লালবাগ সার্কেলে। এই সময়ে তৌহিদ বিন হাসানের বাবা দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক আহসান আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন। বিষয়টি জানাজানি হলে তৌহিদ বিন হাসানকে ঢাকার লালবাগের এসিল্যান্ড থেকে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার এসিল্যান্ড হিসেবে পদায়ন করা হয়। মাত্র ৪ মাস বরিশালে চাকরি করে আবারো গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে পদায়ন নেন।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর তাকে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হয়। সেখানে ২০১৮ সালের বিতর্কিত রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে কাজ করেন। ১৮ এর নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন নবীগঞ্জ উপজেলায়। সেই নির্বাচনে ভোট শুরুর আগেই দুই তৃতীয়াংশ ব্যালট বক্সে ভরে ফেলার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

রাতের ভোটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পুরষ্কার হিসেবে প্রথমে জামালপুর ও পরে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে পদায়ন করা হয় এই কর্মকর্তাকে। এরপর ২০২৩ সালে বিতর্কিত শায়লা ফারজানার হাত ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন নেন তৌহিদ।

প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ এনে ২০১৪ সালের মে মাসে তৌহিদ বিন হাসানের বাবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ পরিচালক আহসান আলীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

পেশাগত জীবনে বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ এবং দুর্নীতির অনুসন্ধান-তদন্ত করা এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর নিকুঞ্জে তার তিনতলা বিলাসবহুল একটি বাড়ি রয়েছে। যা তিনি দুদকে চাকরিরত অবস্থায় নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া খিলগাঁওয়ে রয়েছে আরেকটি বাড়ি। তার নামে-বেনামে রয়েছে নানা সম্পদ।

২০২২ সালের ১৭ মার্চ আহসান আলী দুদকের মহাপরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আবেদন করেন। আবেদনে তিনি বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আব্দুল্লাহ আল নোমান, আমান উল্লাহ আমান, মেজর জেনারেল (অব:) মাজেদুল হক, সৈয়দ শহীদুল হক জামালের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন।

বদলি আদেশ অমান্য করে ছিড়ে ফেলার ঘটনায় সম্প্রতি ১৪ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে এনবিআর। বরখাস্ত হওয়া ঢাকার উপ-প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত কমিশনার) সিফাত-ই-মরিয়ম রাতের ভোটের কর্মকর্তা তৌহিদ বিন হাসান এর স্ত্রী। ঢাকা কাস্টমস হাউজে কর্মরত থাকাকালে তার বিরুদ্ধে স্বর্ণচোরাচালানে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খুনি (ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত) কর্নেল দিলাওয়ার তৌহিদ বিন হাসানের খালু শ্বশুর। এই কর্মকর্তার মামা শ্বশুর শাহজাহান ওমর ছিলেন বিএনপির দলত্যাগী নেতা।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের ৬১ জেলায় ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। সেই নিয়োগ নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেক কর্মকর্তা নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। মারামারি ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে, যা সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করেছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তৌহিদ বিন হাসান ৫ আগস্টের আগে থেকেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তা হয়েও জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ শাখার মতো স্পর্শকাতর জায়গায় কাজ করে যাচ্ছেন। এই শাখা থেকেই মূলত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পদায়ন করা হয়ে থাকে। ডিসি ও সচিব ফিটলিস্ট তৈরির কাজও করছেন তিনি। কৌশলে শায়লার ফারজানার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন এমনকি ডিসি ও সচিব ফিটলিস্টে রাখতে ভূমিকা রাখছেন এই কর্মকর্তা।