টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চাশতম আসর শেষ হয়েছে গত ১৪ সেপ্টেম্বর, কিন্তু এর রেশ এখনো কাটেনি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মাঝে। দশ দিনব্যাপী এ আয়োজনজুড়ে ছিল একের পর এক বিশ্বপ্রিমিয়ার, তারকাখচিত প্রদর্শনী এবং চলচ্চিত্র জগতের বহু প্রতীক্ষিত কিছু নতুন ছবি।
চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা হয়েছিল প্রয়াত কৌতুক অভিনেতা জন ক্যান্ডির জীবনীভিত্তিক ছবি ‘জন ক্যান্ডি : আই লাইক মি’ দিয়ে, যা ছিল উদ্বোধনী রজনীর প্রধান আকর্ষণ। আবেগময় এই প্রামাণ্যচিত্রে ক্যান্ডির ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের অজানা অধ্যায় উঠে আসে, যা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
এবারের আসরে যে ছবিগুলো বিশেষ আলোচনায় এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ক্রিস্টি’ কুস্তিগিরের ভূমিকায় সিডনি সুইনির অভিনয় দর্শকদের চমকে দিয়েছে। একইভাবে ফ্যাশনের পটভূমিতে নির্মিত ‘কুতুর’ ছবিতে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি দেখিয়েছেন অভিনয়ের নান্দনিকতা।
অপরাধ ও পশ্চিমা আমেজের মিশেলে ডেরেক সিয়ানফ্রান্সের ‘রুফম্যান’ ছবিতে চ্যানিং ট্যাটাম ও কিরস্টেন ডানস্টের রসায়ন দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার বহুল প্রতীক্ষিত ছবি ‘ওয়েক আপ ডেড ম্যান’ এ গোয়েন্দা বেনোয়া ব্লাঁ-র চরিত্রে ড্যানিয়েল ক্রেইগ আবারও মুগ্ধ করেছেন। রিয়ান জনসনের পরিচালনায় এটি ‘নাইভস আউট’ সিরিজের নতুন সংযোজন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘নিউরেমবার্গ’ ছবিতে রাসেল ক্রো’র দৃঢ় উপস্থিতি ও জেমস ভ্যান্ডারবিল্টের পরিচালনা বহু প্রশংসা পেয়েছে। অন্যদিকে, আজিজ আনসারির পরিচালনায় নির্মিত ‘গুড ফর্চুন’ ছবিতে সেথ রোজেন ও কিয়ানু রিভসের অনবদ্য জুটি দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছে।
তালিকায় আরও ছিল নামকরা পরিচালকদের নতুন কাজ : ডেভিড ম্যাকেঞ্জির ‘ফিউজ’, স্টিভেন সোডারবার্গের ‘দ্য ক্রিস্টোফারস’, মড অ্যাপাটোর ‘পোয়েটিক লাইসেন্স’ এবং রোমাঁ গাভরাসের ‘স্যাক্রিফাইস’।
এবারের উৎসবে যেমন ছিল বড় প্রযোজনার তারকাখচিত ছবি, তেমনি ছিল নতুন নির্মাতাদের সাহসী পরীক্ষাধর্মী কাজ। সমালোচক ও দর্শক উভয়ের কাছে এই উৎসব ছিল এক গভীর অভিজ্ঞতা, যা আগামী পুরস্কার মৌসুমের পূর্বাভাস হিসেবেও ধরা হচ্ছে।
চলচ্চিত্রের ঝলমলে দুনিয়ায় টরন্টো উৎসব যেমন ছিল সৃষ্টিশীলতার মিলনমেলা, তেমনি এটি হয়ে উঠেছে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আগামী ধাপের মানদণ্ড নির্ধারণের এক অনন্য মঞ্চ।
টিআইএফএফ-এর পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড অনেক সময় অস্কারের ‘সেরা ছবি’র প্রতিযোগিতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয়। গত ১৫ বছরে এই পুরস্কারজয়ী ১২টি চলচ্চিত্র অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছে, আর চারটি শেষ পর্যন্ত সেরা ছবির স্বীকৃতি ঘরে তুলেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে ঝাওয়ের ‘নোম্যাডল্যান্ড’ (২০২০) সেই তালিকায় রয়েছে। তাই এবারের ‘হ্যামনেট’ জয় নিঃসন্দেহে ঝাওকে আবারো অস্কারের দৌড়ে এগিয়ে রাখবে।
বলা দরকার, ‘হ্যামনেট’-এর ঠিক পেছনে ছিল গিলারমো দেল তোরোর ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ এবং রায়ান জনসনের ‘ওয়েক আপ ডেড ম্যান’। এ দুই ছবিও আলোচনায় ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দর্শক ভোটে এগিয়ে গেলেন ঝাও। এ প্রতিযোগিতা প্রমাণ করে টিআইএফএফ এখন এমন এক মঞ্চ, যেখানে শিল্প ও বাণিজ্যিক উভয় ধারা একসাথে মূল্যায়িত হয়।
কানাডিয়ান সিনেমার উত্থান
স্থানীয় চলচ্চিত্রের জন্য বরাদ্দ বিভাগেও সাফল্য এসেছে এবার। ‘রং হাজব্যান্ড’ (জাকারিয়াস কুনুক) সেরা কানাডিয়ান ফিচার ফিল্ম, আর ‘ব্লু হেরন’ (সোফি রোমভারি) সেরা কানাডিয়ান ডিসকভারি। এসব অর্জন কানাডিয়ান সিনেমার আঞ্চলিক গল্পকে বৈশ্বিক আলোচনায় নিয়ে যাচ্ছে।
বলা ভালো, কান, ভেনিস বা বার্লিনের মতো উৎসবের শিল্পধর্মী কঠোরতার বদলে টরন্টো বরাবরই দর্শকপ্রিয়তাকে প্রাধান্য দেয়। এ উৎসবে দর্শকভোটের প্রভাবই আসল শক্তি। ফলে, টিআইএফএফ মূলত এক ধরনের ‘অস্কার পরীক্ষাগার’, যেখানে হলিউডের বড় স্টুডিও থেকে শুরু করে স্বাধীন প্রযোজক- সবার জন্যই ছবির বাজার যাচাইয়ের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়।
২০২৫ সালের টিআইএফএফ প্রমাণ করলো, সিনেমা এখনও দর্শকের হাতেই সবচেয়ে বেশি নির্ধারিত। ক্লোয়ে ঝাওয়ের ‘হ্যামনেট’ সেই দর্শকপ্রেমের শক্তিকে ধারণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে অস্কারের পথে। তবে এ দৌড়ে দেল তোরো, জনসন কিংবা পার্ক চান-উকের মতো নির্মাতারাও যে পিছিয়ে নেই, সেটাও স্পষ্ট হলো। শেষ পর্যন্ত কে এগিয়ে যাবে- তা দেখার জন্য এখন অপেক্ষা শুধু অস্কার মঞ্চের।
৪ সেপ্টেম্বর কানাডার টরন্টো শহরে পর্দা ওঠে ৫০তম টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল-এর পর্দা। যা নামে আজ ১৪ সেপ্টেম্বর। প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী, প্রিমিয়ার, রেড কার্পেট, পার্টি আর জমজমাট আয়োজন শেষে টরন্টোর রোববার সকালে টিআইএফএফ-এর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।



