সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা বজায় রাখা জরুরি

Printed Edition
আমরা যখন বাইরের শত্রুর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করছি, তখন আমাদের ভেতরকার বিশ্বাসঘাতকদেরও চিহ্নিত করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে গুজব ছড়ায়, বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হয় অথবা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দেশের ভেতরে থেকে শত্রুর পক্ষ হয়ে কাজ করছে, তারা সবচেয়ে বিপজ্জনক। তাদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে, আইনের আওতায় আনতে হবে। একইসাথে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশকে ভালো বাসুন। এটি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, শহীদদের রক্তে গড়া, জনতার ভালোবাসায় নির্মিত এবং সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় নিরাপদ। আসুন, আমরা যেন দেশকে বিপর্যয়ে ঠেলে না দিই

যখন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে অবস্থান করছিলেন- যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বার্থে এক কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল। ঠিক তখনই দেশে হঠাৎ করে নানা অস্থিরতা ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা লক্ষ করলেন দেশবাসী। এটি কাকতালীয় নয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টা এবং সেনাপ্রধানকে লক্ষ্য করে সমন্বিতভাবে আক্রমণ শুরু হয়।

আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনী- যে প্রতিষ্ঠানটি আমাদের সার্বভৌমত্বের রক্ষক, সেই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যম একের পর এক অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। প্রশ্ন উঠেছে: প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর কারা বিঘিœত করতে চেয়েছিল? কারা চায় বাংলাদেশকে বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিতে? কাদের লাভ এই বিশৃঙ্খলায়? উত্তরটি সুস্পষ্ট এবং উদ্বেগজনক।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা নিছক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নয়- এটি একটি ঠাণ্ডামাথার ও বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র, যার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে বিদেশী শক্তি, যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কূটনৈতিক অবস্থান ও ভৌগোলিক গুরুত্বকে হুমকি হিসেবে দেখে।

বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মিত্রতা বাড়াচ্ছে এবং আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে তুলছে, তখন এসব বৈরী শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার: বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল করা এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে ফেলা।

এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারা নিচ্ছে নানা ঘৃণ্য কূটকৌশল : ভুয়া খবর ছড়ানো, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। মনগড়া ও কৃত্রিম ভিডিও তৈরি করে সেনাবাহিনীর ভাবমর্যাদা নষ্টের অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে দুষ্টচক্র। সামাজিক মাধ্যমে গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে, যাতে জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বশূন্যতা বা ব্যর্থতা প্রমাণে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল দেখানো যায়। এসব কূটকৌশলের লক্ষ্য শুধু সরকারকে বিব্রত করা বা বদনাম রটানো নয়; বরং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা। কেন? কারণ তারা জানে, সেনাবাহিনী হলো দেশের সবচেয়ে সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও জন আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান। অন্য সবকিছু ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনীর ওপর জাতি নির্ভর করে। তাই সেনাবাহিনীর ভাবমর্যাদা নষ্ট করে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়। একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করে ঘোলা পানিতে স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পেছনে যে অপশক্তিগুলো কাজ করছে, তাদের উদ্দেশ্য শুধু সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করা নয়- তাদের প্রকৃত লক্ষ্য জাতির ভিত্তি, সংহতি ও সার্বভৌম অস্তিত্ব ধ্বংস করা। তারা জানে, সেনাবাহিনী হলো সেই প্রতিষ্ঠান, যা সঙ্কটকালে জাতির শেষ আশ্রয় ও ভরসাস্থল। সর্বোচ্চ আস্থা ও প্রতিরোধের প্রতীক। তারা যেভাবে ষড়যন্ত্র করছে, তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও কৌশলগত। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে তার নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বে প্রশ্ন তুলছে। বাহিনীর নেতৃত্বের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সৈনিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। অভ্যন্তরীণভাবে দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে ঐক্য বিনষ্টের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। সর্বোপরি, বাহিনী ও জনগণের পারস্পরিক আস্থা নষ্ট করে একটি ‘বিশ্বাসহীন রাষ্ট্র’ তৈরি করতে চাইছে। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব শুধু সেনাবাহিনীর গঠনতন্ত্রে নয়; বরং সম্পূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রে বিশৃঙ্খলা ও ভাঙন সৃষ্টি করবে। এর ফল হতে পারে বহুমাত্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী- যার প্রভাব পড়বে জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে।

১. দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর চরম আঘাত: সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দিলে দেশরক্ষার সক্ষমতা ব্যাহত হবে। আমাদের চারপাশে যে ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন চলছে, সেখানে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছাড়া কোনো দেশ নিরাপদ নয়। যদি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে কিংবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দুর্বল হয়, তাহলে বাইরের শক্তিগুলো সহজে সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে।

২. জাতীয় সংহতি দুর্বল করা: সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিরক্ষাবাহিনী নয়, এটি একটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। সব অঞ্চল, ধর্ম, ভাষা ও সম্প্রদায়ের মানুষ এ বাহিনীতে কাজ করেন। যদি এ বাহিনীকে বিভাজনের টার্গেট করা হয় এবং জনগণ তার প্রতি অবিশ্বাসে ভোগে, তবে জাতিগত বিভক্তি, আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং বিদ্বেষমূলক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। জাতীয় সংহতি ভেঙে গেলে দেশ টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়েবে।

৩. সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা : একটি অস্থির রাষ্ট্রে কখনো অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। যখন সেনাবাহিনী নিয়ে বিতর্ক, দোষারোপ আর জনমনে দ্বিধা জন্মায়, তখন সামগ্রিকভাবে সমাজে অস্থিরতা, ভীতিকর পরিবেশ এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যান, উন্নয়ন থমকে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক দলগুলো সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্র ক্রমশ চরম স্থবিরতায় নিপতিত হয়।

৪. বিদেশী হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি : সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিণতি হলো- বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হস্তক্ষেপ। যখন একটি রাষ্ট্র দুর্বল, বিভক্ত ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে, তখন বাইরের শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করে না। এ হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক- যেকোনো রূপ নিতে পারে। একবার যদি বিদেশী প্রভাব ঢুকে পড়ে, তাহলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া বড়ই কঠিন।

এসব ষড়যন্ত্র রুখতে হলে আমাদের জাতীয়ভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা বজায় রাখতে হবে। গুজব ও অপপ্রচার প্রতিহত করতে হবে। রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণায় যারা অংশ নিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেই সাথে প্রত্যেক নাগরিককে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দায়িত্ববান হতে হবে।

জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী ও জনগণের সম্পর্ক একটি অমূল্য শক্তি। এ সম্পর্ক যে বা যারা ভাঙতে চায়- তাদের উদ্দেশ্য দেশবিরোধী। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম হতে হবে সুসংগঠিত, গণভিত্তিক ও বিবেকসম্পন্ন। জাতির শক্তি তার ঐক্যে এবং সেই ঐক্যের মূল স্তম্ভ হলো সেনাবাহিনী ও জনগণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এ বন্ধন অটুট রেখে- দেশকে রক্ষা করতে হবে। যড়যন্ত্রকারীদের কূটকৌশল, ভেতর থেকে ধ্বংস এ অপকৌশলের বিপজ্জনক দিক হলো- তারা বিদেশী শক্তির হয়ে কাজ করে, কিন্তু তাদের চরিত্র দেশীয়। তারা বাংলাদেশের ভেতরে বসে, পরিচিত মুখে, পরিচিত অবস্থান থেকে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি কিছু সংবাদপত্র- সব জায়গাতে কিছু সুবিধাভোগী এবং বিশ্বাসঘাতক সক্রিয়।

তাদের উদ্দেশ্য হলো ধীরে ধীরে মানুষের মনে সন্দেহ, হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়ে এমন একটি আবহ তৈরি করা, যেখানে সেনাবাহিনী আর জনগণের চোখে আস্থার প্রতীক না থাকে। যদি এ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর এই সম্পর্ক ভেঙে পড়ে, তবে তা হবে জাতির জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। সতর্ক না হলে আমরা নিজেরা নিজেদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ বা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে ফেলব। এটি শুধু ষড়যন্ত্র নয়- এটি এক অঘোষিত যুদ্ধ; এ যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমাদের সবার আগে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দুর্যোগ মোকাবেলা, জাতীয় নিরাপত্তা এবং শান্তিরক্ষায় সর্বদা জনগণের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক। দেশের প্রতিটি সঙ্কটকালে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দেশের জন্য কাজ করছে। কিন্তু আজ সেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চলছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- যখন একটি দেশের সেনাবাহিনী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে, অবিশ্বাস ও বিশৃঙ্খলার জন্ম নেয়। সেনাবাহিনী যদি জনগণের সমর্থন হারায়, অথবা জনগণ যদি সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা হারায়- তা হলে জাতিকে বিপজ্জনক পথে ঠেলে দেয়া হয়, যার পরিণতি হয় ভয়াবহ।

এখন সময় জাতীয় সচেতনতার। বিভ্রান্তির নয়। আমাদের গুজবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, বানোয়াট ও মনগড়া তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন যুদ্ধের ময়দান- এখানে আমাদের বিবেক, তথ্য যাচাই ও সচেতনতা হচ্ছে প্রধান অস্ত্র। আমাদের এগুলো ব্যবহার করতে হবে দায়িত্বশীলতার সাথে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষায়, বিদেশী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে, সঠিক তথ্য প্রচার করতে এবং সামরিক বাহিনী ও জনগণের সম্পর্ক অটুট রাখতে। কারণ জনগণ সেনাবাহিনীর শক্তি, আর একটি পেশাদার ও বিশ্বস্ত সেনাবাহিনী দেশের রক্ষাকবচ।

আমরা যখন বাইরের শত্রুর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করছি, তখন আমাদের ভেতরকার বিশ্বাসঘাতকদেরও চিহ্নিত করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে গুজব ছড়ায়, বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হয় অথবা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দেশের ভেতরে থেকে শত্রুর পক্ষ হয়ে কাজ করছে, তারা সবচেয়ে বিপজ্জনক। তাদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে, আইনের আওতায় আনতে হবে। একইসাথে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশকে ভালো বাসুন। এটি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, শহীদদের রক্তে গড়া, জনতার ভালোবাসায় নির্মিত এবং সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় নিরাপদ। আসুন, আমরা যেন দেশকে বিপর্যয়ে ঠেলে না দিই। সেনাবাহিনী একা কিছু করতে পারে না। জনগণের আস্থা, সমর্থন ও ঐক্যই সেনাবাহিনীর শক্তি। জেগে উঠুন। বিভ্রান্ত হবেন না। বিভাজনের ফাঁদে পা দেবেন না।

লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক