১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগের সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে রাজধানীর তোপখানা রোডে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নির্মিত জনতার মঞ্চে এসে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা। ওই বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে ২০০২ সালের ৮ আগস্ট জনতার মঞ্চে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়। পরে ২০০৯ সালে আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে আবারো এই মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মামলাটির বিষয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। মামলাসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ উল্লেখ করে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইন) মো: সুজায়েত উল্লাহ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানো হয়। চিঠির অনুলিপি পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকার মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরকে পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, “সরকার ‘ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৮৯’ এর ৪৪৯ ধারার আওতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার রমনা থানায় মামলা নম্বর ৩০, তারিখ ৮-৪-২০০২ এর প্রসিকিউশন না চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাই মামলাটি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে মহানগর পিপিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।”
এই চিঠি পাঠানোর এক সপ্তাহ পর ‘জনতার মঞ্চ’ মামলার দায় থেকে সাবেক সচিব আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ সাতজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোসাম্মৎ ফজিলা বেগম এ আদেশ দেন।
অব্যাহতি পাওয়া অন্যরা হলেন- সাবেক সচিব শফিউর রহমান, যুগ্ম সচিব সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব রবিউল আলম মো: উবায়দুল মুক্তাদির আহমেদ চৌধুরী, উপ প্রেস সচিব মো: আবু আলম শহীদ খান, সাবেক পুলিশ সুপার সৈয়দ ফজলুল করিম, সৈয়দ মহিউদ্দিন।
মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর অব্যাহতির আবেদনে বলেন, “সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সরকার এ মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
মামলার নথিতে বলা হয়, ‘যেহেতু রাষ্ট্র আসামিদের বিরুদ্ধে অত্র মামলা পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। ফলে এই মামলা পরিচালনার আর কোনো উপাদান আছে বলিয়া প্রতীয়মান হয় না। নথি পর্যালোচনান্তে দেখা যায় যে, মহামান্য হাইকোর্ট থেকে অত্র মামলার রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হইয়াছিল। দরখাস্ত সঙ্গে সংযুক্ত কাগজপত্র হতে দেখা যায় যে রুলটি নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছে। ইতিমধ্যে চার্য গঠিত হয়। ফলে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রশিকিউশন প্রত্যাহার করায় আসামিদের অত্র মামলার অভিযোগের দায় হইতে খালাস দেওয়া গেল।’
সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খানকে গ্রেফতার করে সরকার। আবু আলম শহীদ গত ২৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মঞ্চ ৭১‘এর একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং ‘সরকাবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৯৬ সালে সচিবালয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারবিরোধী ‘জনতার মঞ্চের’ অন্যতম সংগঠক ছিলেন সাবেক আমলা আবু আলম শহীদ খান। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি শেখ হাসিনা উপ প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে শহীদ খানকে ওএসডি হয়ে থাকতে হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তিন মাসের মধ্যে পরপর চারটি পদোন্নতি দিয়ে তাকে জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়।
সে সময় তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী সচিব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে তিনি ২০১৫ সালে অবসরে যান। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর কিছুদিন যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন সাবেক এই আমলা।
একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের অপরাধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাবেক সচিব ভুঁইয়া মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত। তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই তৌফিক হাসান। অপর দিকে তার আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুল ইসলাম তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
প্রসঙ্গত আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও সাবেক সচিব শফিকুল ইসলামসহ এজহারনামীয় ১৬ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৭০/৮০ জন পরস্পর সহায়তাকারী হিসেবে দেশকে অস্থিতিশীল করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনার অপরাধে শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ২৯ আগস্ট একটি মামলা দায়ের করা হয়।