রক্তরঞ্জিত জুলাই-২৪

পরিচয়হীন ৮ লাশ দাফন ময়নাতদন্ত ছাড়াই

চিরুনি অভিযানে গ্রেফতার ১,৪০০

২৪ জুলাই সারা দেশে আন্দোলনকারীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রায় এক হাজার ৪০০ জনকে গ্রেফতারের মধ্যে ঢাকায় ৬৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

আমিনুল ইসলাম
Printed Edition

২৪ জুলাই ২০২৪ বুধবার। ঢাকা মেডিক্যালের হিমঘরে লাশ রাখার জায়গা ছিল না। যার কারণে ৮টি লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দিয়ে দাফন করানো হয়। এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ আরো চারজনের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে ছিল ৬ বছরের রিয়া মনি। এদিকে সারা দেশে চিরুনি অভিযানে এক হাজার ৪০০ জনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। টানা পঞ্চম দিনের মতো সারা দেশে কারফিউ বলবৎ ছিল, তবে এদিন তা শিথিল রাখা হয়।

বুধবার হাসপাতাল সূত্র জানায়, নিহত রিয়া আক্তারের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায়। গত ২০ তারিখ রিয়া অন্য শিশুদের সাথে বাড়ির সামনে খেলা করছিল। এমন সময় সংঘর্ষ এলাকা থেকে আসা একটি গুলি তার শরীর বিদ্ধ করে। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২৪ জুলাই সারা দেশে আন্দোলনকারীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রায় এক হাজার ৪০০ জনকে গ্রেফতারের মধ্যে ঢাকায় ৬৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে গত ৮ দিনে (১৭-২৪ জুলাই) সারা দেশে গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার হাজার। রাজধানীতে মোট এক হাজার ৭৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। চট্টগ্রামে গ্রেফতার করা হয় মোট ৭০৩ জনকে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী। গ্রেফতারের বিষয়ে তৎকালীন ডিবি প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজ দেখেই অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

৫ দিন পর ২৪ জুলাই রাতে সারা দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করে বিটিআরসি। তবে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মেট্রোরেল এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ রাখা হয়।

এদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয় বলে দু’জনই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে আহত হয়ে এদিন চিকিৎসাধীন আরো চারজনের মৃত্যু হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ও সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাতে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ২০১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ঢাকাসহ তিন জেলায় বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। অন্যান্য জেলায়ও জেলা প্রশাসকদের নির্ধারিত কয়েক ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকে। এদিন সরকারি অফিস ও ব্যাংক চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি রাস্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও টহল অব্যাহত ছিল। এ ছাড়াও এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মতবিনিময় সভা করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকরা।

কারফিউ শিথিল হওয়ায় এদিন রাজধানী থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়। ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়। এদিন অফিস-আদালত ও কলকারখানায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার যেসব স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মেট্রোরেলসহ কয়েকটি স্থাপনা সরকারের উদ্যোগে বিদেশী কূটনীতিকদের সরেজমিন পরিদর্শন করানো হয়।

এ বিষয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, মোট ৪৯টি মিশনের প্রতিনিধিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কয়েকটি স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কূটনীতিকদের মেট্রোরেলের ধ্বংসযজ্ঞ, সড়ক ভবন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিটিভি ভবন দেখিয়েছি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৬ জুলাই ৬ জন নিহতের ঘটনা তদন্তে ২৪ জুলাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে গত ১৬ জুলাই সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জানতে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জনগণের কাছে তথ্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তদন্ত কমিটি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার কথা জানায় এই কমিটি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় নিহত আটজনের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ফলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পড়ে থাকা লাশগুলো বুধবার বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দুষ্কৃতকারীরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, জনমনে স্বস্তি না ফেরা পর্যন্ত কারফিউ চলবে। নরসিংদী কারাগার থেকে পালানো দুই নারী ‘জঙ্গি’ ইশরাত জাহান মৌসুমী ওরফে মৌ ও খাদিজা পারভীন মেঘলাকে গ্রেফতার করে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট। এ ছাড়া পালিয়ে যাওয়া কারাবন্দীদের মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ২৯২ জন আত্মসমর্পণ করেন। সারা দেশে অবিলম্বে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেয়াসহ চার দফা দাবি জানিয়ে ২৩ জুলাই দুই দিনের আলটিমেটাম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একাংশ। অন্যদিকে নিজেদের ৯ দফা দাবি আদায়ে ২৫ জুলাই দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করে সমন্বয়কদের আরেক পক্ষ।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাদের ওপর হামলা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এদিন প্রতিক্রিয়া জানায় মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন। পেন্টাগনের মুখপাত্র মেজর জেনারেল প্যাট রাইডার বলেন, তারা বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নজরে রেখেছে। একইসাথে পেন্টাগন সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সরকার যত দিন চাইবে, সেনাবাহিনী তত দিন বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতায় দায়িত্ব পালন করবে।

জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন সেমিস্টারের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেই পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। চলমান পরিস্থিতির কারণে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এতে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা, অর্ধবার্ষিক বিভাগীয় পরীক্ষা (জুন-২০২৪), নন-ক্যাডারের স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপটিচুড টেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা স্থগিত থাকে।