ঘড়ির কাঁটা ভোটের তফসিলের অপেক্ষায়

আজ দুপুরে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের সাথে সিইসির নেতৃত্বে পুরো কমিশন দেখা করবেন। তার পরই জাতির উদ্দেশে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড করা ভাষণের মাধ্যমে সিইসি তফসিল ঘোষণা করবেন।

হামিদ সরকার
Printed Edition

  • আজ সন্ধ্যায় বা কাল তফসিল দেবেন ইসি

  • সিইসি দেখা করলেন প্রধান বিচারপতির সাথে

  • রাষ্ট্রপতির সাথে আজ দুপুরে ইসির সাক্ষাৎ

  • চূড়ান্ত ব্যালটে স্থগিত বা নিষিদ্ধ দলের প্রতীক থাকবে না

ভোটের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ঘড়ির কাঁটা তফসিলের অপেক্ষায়। আজ বুধবার সন্ধ্যায় বা আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তবে আজ দুপুরে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের সাথে সিইসির নেতৃত্বে পুরো কমিশন দেখা করবেন। তার পরই জাতির উদ্দেশে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড করা ভাষণের মাধ্যমে সিইসি তফসিল ঘোষণা করবেন। এই তফসিলের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ গতকালই জানিয়েছেন বুধবার ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অথবা বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, কাল রাষ্ট্রপতির সাথে দুপুরে সাক্ষাতে যাবেন সিইসির নেতৃত্বে পুরো কমিশন। সেই সাক্ষাৎ শেষে তফসিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কমিশনের দায়িত্ব পাওয়ার পর কোনো ধরনের নির্বাচন আয়োজন করার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে চ্যালেঞ্জ নিয়েই তারা এই ভোটের আয়োজনে যাচ্ছেন।

চ্যালেঞ্জ এক দিনে দুই ভোট : নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এবার ইসিকে ভোট করতে হবে। এবার সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিন গণভোটও হবে। এটিকে একটি অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ইসি। বিশেষ করে ভোট গ্রহণের সময় ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হবে, তা নিয়ে ইসিকে ভাবতে হচ্ছে। তারা বলছেন, একজন ভোটারকে দুটি করে ভোট দিতে হবে। এতে ভোট দিতে সময় বেশি লাগবে। এ জন্য ভোটকেন্দ্র বা ভোটকক্ষ বাড়াতে হবে কি না, তা বুঝতে গত শনিবার রাজধানীর একটি ভোটকেন্দ্রে মক ভোটিংয়ের আয়োজন করেছিল ইসি। ওই মক ভোটের প্রাথমিক তথ্য পর্যালোচনায় ইসি বলেছে, প্রতিটি ভোটকক্ষে একটির জায়গায় দুটি করে গোপন কক্ষ (যেখানে গিয়ে ভোটার ব্যালট পেপারে সিল দেন) স্থাপন করা হলে ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে না। গোপন কক্ষ বাড়ানো এবং ভোট গ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ইসি।

প্রস্তুতি প্রায় শেষ : ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইনবিধি সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, প্রয়োজনীয় কেনাকাটাসহ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে যেসব প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন হয়, ইতোমধ্যে সেগুলো শেষ হয়েছে। এমনকি পোস্টাল ব্যালটে ভোটের ব্যাপারে বিদেশে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিবন্ধনও জোরেশোরে চলছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দুই লাখ ৮০ হাজার ৯০০ জন নিবন্ধিত হয়েছেন। আইন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যারা থাকবেন তাদের প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন বিষয়ে ২০টির মতো পরিপত্র জারি হবে। সেখানে মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি নিয়োগ, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইনশৃঙ্খলার সেল গঠন এগুলোর ফরমেটগুলো রেডি রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর পর সেগুলো ধারাবাহিকভাবে জারি করা হবে।

মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন ঢেলে সাজাচ্ছে : আগের নির্বাচনগুলো হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল শুরু করেছে। জাতীয় নির্বাচনে সাধারণত ৬৪ জেলার ডিসি এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনাররা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ইউএনওরা থাকেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। এ ছাড়া লটারির মাধ্যমে ৬৪টি জেলায় পুলিশ সুপার (এসপি), মহানগরগুলো বাদে ৫২৭টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পদায়ন করা হয়েছে। তবে নতুন করে ডিসি পদায়ন করা হয়েছে ৩১জন। বাকিদের শুধু এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি করা হয়েছে।

যা বলছেন কমিশনার মাছউদ : এ দিকে, আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনে তার দফতরে গতকাল সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এ তথ্য জানান। আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় ভাষণের সব কিছু চূড়ান্ত। রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ শেষে বুধবার (১০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় অথবা বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণায় রাজনৈতিক দলসহ সবার সহযোগিতার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হবে। আগামীকাল দুপুরে রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবে নির্বাচন কমিশন। তিনি বলেন, চূড়ান্ত পোস্টাল ব্যালটে নিষিদ্ধ বা স্থগিত কোনো দলের প্রতীক থাকবে না।

প্রধান বিচারপতির সাথে সিইসি : সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন গতকাল দুপুরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সাথে বৈঠক করেন। সেখানে সীমানা সংক্রান্ত মামলা এবং তফসিল ঘোষণার পর যেন কোনো রিট নির্বাচন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া নির্বাচনের কাজের সহযোগিতার জন্য সিইসি তার কাছে ৩০০ বিচারিক কর্মকর্তা চেয়েছেন বলে সংশিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আদালতের বিচারকদের নির্বাচনী দায়িত্ব নিয়েও আলাপ হয়েছে বলে জানা গেছে। সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, এই সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা করা হবে। তিনি ইসির প্রস্তুতির বিষয়েও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

মক ভোটিংয়ে গড়ে প্রতিজনে ৩.৫২ মিনিট : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ উপলক্ষে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো: সানাউল্লাহ বলেন, এবার নির্বাচনে দুটি ব্যালট থাকছে। তাই সময় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। মক ভোটিং করে ইসি দেখেছে, একজন ভোটার গড়ে ৩ মিনিট ৫২ সেকেন্ড সময় নিয়েছেন। যে ভোটার গণভোটের ব্যালট না পড়ে ভোট দিয়েছেন তার ২ মিনিট আর যিনি পড়েছেন তার ভোট দিতে ৭-৮ মিনিট সময় লেগেছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : আসন্ন ভোটের ব্যাপারে সম্প্রতি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রধান নির্বাহী বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পুরো দেশ ও বিশ্ব আসন্ন এই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। আমরা আশা করছি, দীর্ঘ সময় পর মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, ইসি যে সময়সীমার কথা বলেছে, এর মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। সব কিছু সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে। দেশ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে সহযোগিতা করবে।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলি বলেন, কমিশনকে বেশ চ্যালেঞ্জ নিয়েই তফসিল দিতে হচ্ছে। তবে তফসিল দেয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে বোঝা যাবে সব কিছু। তিনি বলেন, তফসিলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব প্রচার-প্রচারণা তুলে ফেলতে হবে।

ভোট ও তফসিলের ব্যাপারে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, নির্বাচন তদন্ত কমিশন ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবদুল আলীম নয়া দিগন্তকে বলেন, এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন আছে। এটা নির্বাচনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ভালো এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে গেলে সব দলকে ঐকমত্যে আসতে হবে। তবে আমার ধারণা, তফসিল ঘোষণার পর হয়তো এই বিভাজনটা থাকবে না। তিনি বলেন, দুটো নির্বাচন গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক দিনেই হওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হলো মাঠ প্রশাসন। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও কোথাও কোথাও কিন্তু ভায়োলেন্স হচ্ছে। জামায়াতের সাথে। বরিশালে দেখলাম ফুয়াদের সাথে। নোয়াখালীতে আ স ম রব সাহেবের স্ত্রীর সাথে। এই সংঘর্ষগুলো বাড়ার সম্ভাবনা আছে তফসিলের পর। এইগুলো নিয়ন্ত্রণ করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার প্রতিরোধ করা বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলোকে তারা কিভাবে মনিটরিং করবেন? এসবের মাধ্যমে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হবে।