ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী
বড় বিষয় হচ্ছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তাকে ধরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই সেই ঐক্য নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। সৃষ্ট জাতীয় ঐক্য যদি বিনষ্ট হয় তাহলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। তাই এখনই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং চলমান প্রক্রিয়া। তাই তাৎক্ষণিকভাবে সব সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে, এটি ভাবা ঠিক নয়। এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ভুলে যেতে হবে
ফরাসি দার্শনিক রুশো তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে লিখেছেন, MAN IS BORN FREE BUT EVERYWHERE HE IS IN CHAIN. অর্থাৎ- মানুষ স্বাধীনভাবেই জন্মগ্রহণ করে কিন্তু পরবর্তীতে সে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। যুগে যুগে মানুষের অধিকার হরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। আর মানুষের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে রয়েছে সরকার। কোনো দেশের সরকার যখন হৃদয়হীন ও গণবিরোধী হয়ে ওঠে হীনস্বার্থ চরিতার্থের চেষ্টা করে তখন সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করে। শাসকগোষ্ঠী জনগণের উপর নির্যাতন-নিষ্পেষণ যত বৃদ্ধি করে মানুষ ততই সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। একসময় তাদের সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। কারণ নির্যাতিত হতে হতে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। তখন আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। গত বছর জুলাই-আগস্টে আমরা সেই বিষয়টিই প্রত্যক্ষ করি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। প্রতিবাদের কোনো উপায় কার্যত অবশিষ্ট ছিল না তখনই দেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে শুরু করে। প্রথমে ছাত্ররা তাদের নিজস্ব দাবি অর্থাৎ শিক্ষাজীবন শেষে চাকরির অবাধ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে কোটা সুবিধা পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সুবিধা যৌক্তিকভাবে সংস্কারের লক্ষ্যে তারা তীব্র আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে নানাভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনকে কোটা সংস্কারের সীমিত গণ্ডির বাইরের এনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেন। এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন আরো বৃহত্তর রূপ পরিগ্রহ করে এবং পর্যায়ক্রমে তা সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবিতে পরিণত হয়। সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। গৃহবধূরা পর্যন্ত পানির বোতল নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়ান। সরকার আন্দোলন দমনে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এমনকি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করা হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। সরকারের নির্যাতন যত বৃদ্ধি পায় আন্দোলন ততই গতিশীলতা লাভ করে। একপর্যায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন। শিক্ষার্থীদের আত্ম উৎসর্গকারী আন্দোলন সফলতা অর্জন করে। বাংলাদেশ এক নতুন যুগে পদার্পণ করে। ইতঃমধ্যেই শিক্ষার্থীদের সফল আন্দোলনের এক বছর পূর্তি হতে চলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এখন তাদের কাজের প্রাথমিক মূল্যায়নের সময় এসেছে। কারণ এক বছর একটি অনির্বাচিত সরকারের জন্য খুব কম সময় নয় ।
প্রথমেই আমাদের শিক্ষার্থী আন্দোলনের মূল উপজীব্য অনুসন্ধান করতে হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব দাবি নিয়ে প্রাথমিকভাবে আন্দোলন শুরু করেছিল। সরকার পতন সেই আন্দোলনের দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ছিল না। তারা সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা সংস্কার চেয়েছিল। কিন্তু সরকার তাদের সেই দাবিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে নানাভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে। বিশেষ করে ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু আপত্তিকর বক্তব্য শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে তোলে। ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বের নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচারী দানবে পরিণত হওয়ার পেছনে দেশের রাজনৈতিক দুরবস্থাই মূলত দায়ী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। শুরু থেকেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গণ-আকাক্সক্ষার পরিপন্থী কাজ শুরু করে। তারা নির্মম ও নিষ্ঠুর শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। দেশে বিভীষিকাময় অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। বিগত সাড়ে ১৫ বছর বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। সরকার নানাভাবে বিতর্কিত পন্থায় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিক্ষোভরত মানুষকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক কর্মীদের গুম-খুন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের হাতে দেশের মানুষের অধিকার এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা নিরাপদ নয়- এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানে পারিবারিক শাসন কায়েমের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তদ্বীয় কন্যা শেখ হাসিনা তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে তাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন। একজন নারী যে কতটা নির্মম ও নিষ্ঠুর হতে পারে তা শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করলেই অনুধাবন করা যায়। গণ-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসন কায়েমের পরিণতি কি হতে পারে শেখ হাসিনা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। বাংলার ইতিহাসে রাজা লক্ষণ সেনের পর শেখ হাসিনা সেই ব্যক্তি যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলা না করেই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা যদি সে দিন পালিয়ে না যেতেন তাহলে তার পরিণতি কী হতো তা ভাবলেও গা শিউরে উঠে ।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার মধ্যে আজীবন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখার বাসনা জাগ্রত হয়েছিল। তারা মনে করতেন, দেশটা তাদের নিজস্ব সম্পত্তি এবং এর শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদের পরিবারেরই আছে। শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় আসীন থাকার স্বপ্ন দেখতেন। তার দলের কোনো কোনো নেতা এমনটিও বলেছেন, আগামী ১০০ বছরেও কেউ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। এটি বলার কারণ হলো- তারা একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সহায়তায় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এমন একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিলেন যাতে শেখ পরিবারের বাইরের কেউ রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে আসীন হতে না পারেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় পারিবারিক আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি মনে করতেন, তিনিই সেরা, তার উপরে আর কেউ নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা এবং অধিকার তারই রয়েছে। তিনি কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগের হাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেনতাকে ধারণ করতেন না, তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেনতাকে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। শেখ হাসিনার রাজনীতি ছিল পরস্পরবিরোধী। তিনি এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন। দাবি আদায়ের নামে ‘লগি-বৈঠা’ দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি প্রথমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তার অনুগত আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির আওতায় বাংলাদেশে যতগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার প্রতিটিই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচনেই একটি দল পরপর দু’বার সরকার গঠন করতে পারেনি। শেখ হাসিনার ভয় ছিল সেখানেই। তিনি জানতেন, যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা তার নেই। তাই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে বাতিল করে তার ক্ষমতার লিপ্সা চরিতার্থ করেন। দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এই তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং কলঙ্কিত নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শেখ হাসিনা যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত না করতেন তাহলে সাধারণ মানুষ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন। শেখ হাসিনা বারবার ক্ষমতায় আসতে না পারলেও তার আজকের এই পরিণতি ভোগ করতে হতো না। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব। তাই এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূলে মত দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিভাবে গঠিত হবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা রয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর প্রধান হিসেবে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হলেই তিনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বা করবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ বিগত সরকার আমলে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকেও কলুষিত করা হয়েছে। সমাজে যাদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে, দৃশ্যত যারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত নন এবং পেশাগত জীবনে যারা সর্বোচ্চ সততার পরিচয় দিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ বা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা যেতে পারে। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নিয়মিত সরকার নয়। তাদের প্রতি রাজনৈতিকভাবে কোনো জনসমর্থন নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকাল যতই প্রলম্বিত হবে সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অনীহা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা এমনটি করতে পারত না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। তারা চাইলেই সব সমস্যা রাতারাতি সমাধান করতে পারবে না। কিছু সমস্যা আছে যা একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই সমাধান করা সম্ভব। তাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনী সংস্কার সম্পন্ন করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে দিলেই হবে। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে তা সম্পন্ন করবে। অনেকেই বলেন, রাজনৈতিক সরকার সংস্কারকার্য সম্পন্ন করবেন তার নিশ্চয়তা কি? রাজনৈতিক সরকার যদি জনপ্রত্যাশা মোতাবেক প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হয় তাহলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে জনগণ তার উপযুক্ত জবাব দেবে। কাজেই সংস্কারের নামে জাতীয় নির্বাচন প্রলম্বিত করা কোনোভাবেই সঙ্গত হবে না।
এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কিছু ইস্যুতে আশু দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। প্রতিবার গণআন্দোলনের পর কয়েক দিন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটে। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু এবার তার ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে মব কালচার। বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণীর মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণ চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একশ্রেণীর সদস্য দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। গোপালগঞ্জে তাদের দলীয় কর্মসূচি পরিচালনাকালে এনসিপি নেতাদের উপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। পুলিশের কাছে আগে থেকেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে খবর ছিল। কিন্তু তারপরও তারা যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কেন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে তা স্বাভাবিক বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এর পেছনে পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের ইন্ধন থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই পুরো বিষয় খতিয়ে দেখে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের যেসব সদস্য দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করছে তাদের চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুতকরণসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিগত সরকার আমলের সাড়ে ১৫ বছর সময়কালে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণের মাধ্যমে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যারা বিগত সরকারের বিশেষ আনুকূলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি অর্জন করেছেন তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করবেন- এটিই স্বাভাবিক। যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়শই আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা হচ্ছে। এসব আন্দোলনকে স্বাভাবিক আন্দোলন মনে করার কোনো কারণ নেই। বিগত সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই এসব আন্দোলনের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। সরকার যদি অযৌক্তিক ইস্যুকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে পরিস্থিতি খুব সহসাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের আন্দোলন। সরকার আইএমএফের পরামর্শ মোতাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের উদ্যোগ নিলে প্রতিষ্ঠানটির একশ্রেণীর কর্মকর্তা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মাসাধিককাল ধরে চলা আন্দোলনের ফলে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম বিঘিœত হয়। সরকার আন্দোলনকারীদের প্রতি কোনো ধরনের অনুকম্পা প্রদর্শন না কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আন্দোলনকারী নেতাদের কয়েকজনের অর্জিত সম্পদের ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিলে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। তারা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন।
আন্দোলনকারীদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থিত হয়ে ক্ষমতা প্রার্থনা করেন। যেসব প্রতিষ্ঠানের অযৌক্তিক ইস্যুতে আন্দোলন করবে তাদের সবার বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। রাজনৈতিক সরকারের প্রতি সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের যে ভীতি থাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তা না থাকাই স্বাভাবিক। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে এসব আন্দোলন এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের উপর যে বাড়তি শুল্কারোপ করেছে তা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো। ভিয়েতনাম তার রফতানি পণ্যের উপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহার ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে হয়তো বিষয়টি অন্য রকম হতে পারতো।
প্রচণ্ড দৃঢ় ঐক্যের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রবল পরাক্রমশালী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। শিক্ষার্থীরা রাজপথে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছে। তাদের সেই অবদান কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কিন্তু তাই বলে আন্দোলনের প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না। সম্মিলিত উদ্যোগেই স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে যে ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠেছিল গত এক বছরে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। বিশেষ করে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ ও বক্তব্যের কারণে সৃষ্ট ঐক্য অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। আমরা যদি ঐক্য ধরে রাখতে না পারি তাহলে তার বেনিফিশিয়ারি হবে পতিত স্বৈরাচার। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের অনেকেই দেশত্যাগ করেছেন। অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন কিন্তু তাই বলে তাদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে- এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আর আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই রাজনৈতিক দল যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করে তার দায়ভার বিরোধী পক্ষের উপর চাপাতে অত্যন্ত দক্ষ। তাই সতর্কতার সাথে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তাকে ধরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই সেই ঐক্য নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। সৃষ্ট জাতীয় ঐক্য যদি বিনষ্ট হয় তাহলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। তাই এখনই সবাইকে সতর্ক হতে হবে।
সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং চলমান প্রক্রিয়া। তাই তাৎক্ষণিকভাবে সব সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে, এটি ভাবা ঠিক নয়। এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ভুলে যেতে হবে। আমাদের এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আর কোনো স্বৈরাচারী সরকারের কবলে না পড়ে ।
আমি আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করবে, যার মাধ্যমে একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সূচনা হবে।