সংশোধন প্রক্রিয়ায় থাকা মার্জিন রুলস আতঙ্কে সূচকের পতন

বিএসইসি বলছে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিক দরপতনের জন্য বেশ কয়েকটি কারণকে সামনে আনছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক মার্জিন রুলস সংশোধন প্রক্রিয়া। আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আর্থিক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে পুঁজিবাজার সংস্কারের প্রতিও মনোযোগী হয় অন্তবর্তী সরকার। গঠিত হয় পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স, যারা সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ইতোমধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে বেশ কিছু সুপারিশ জমা দেন। এগুলোর অন্যতম ছিল মার্জিন রুলস সংশোধন।

সংস্কার টাস্কফোর্সের সুপারিশের আলোকে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ( বিএসইসি) সাম্প্রতিক সময়ে একটি সংশোধন প্রস্তাব তৈরি করে তা জনমত জরিপের জন্য অংশীজনের কাছে প্রকাশ করে। অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতেই এ সংশোধনী গৃহীত হতে পারে, যা পরবর্তিতে আইনে পরিণত এবং কার্যকর হতে পারে। এ সংশোধন প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গতানুগতিক ধারাতে নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি করে, যার ফল পুঁজিবাজারে গত কয়েক দিনের ধারাবাহিক দরপতন। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিএসইসির এ সংশোধনী প্রস্তাবটি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের পাশাপাশি ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মাঝে পৌঁছলে তারা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন, যা বাজারের ধারাবাহিক পতন ঘটাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সৃষ্ট এ আতঙ্কের কারণে গত এক মাসের মধ্যে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকটি হারিয়েছে প্রায় ৫০০ পয়েন্ট।

কী আছে বিএসইসির সংশোধনী প্রস্তাবে: একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিকিউরিটিজ হাউজের শীর্ষ নির্বাহীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, বড় দাগে সংশোধনীর যে বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো কোনো সিকিউরিটিজ মার্জিন ঋণ পেতে কোম্পানিটির শেয়ারদর কোম্পানির শেয়ারের অভিহিত মূল্যের ৭ গুণের বেশি হলে তা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শতভাগ ঋণ দেয়া যাবে না। গুণিতক হিসাবে এভাবে দর যত বেশি হবে ততই ঋণসীমা হ্রাস পাবে।

এ ছাড়া কোনো কোম্পানি মার্জিন ঋণ পেতে হলে অবশ্যই কোম্পানিটি ‘এ’ বা ‘এন’ ক্যাটাগরিতে থাকতে হবে। ‘বি’ বা ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো মার্জিন ঋণের বাইরে থাকবে। আবার কোনো কোম্পানি যদি কোনো কারণে নন-মার্জিনেবল হয়ে পড়ে অর্থাৎ ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘বি’ বা ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে যায় তা হলে পরবর্তী পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে সে শেয়ার বিক্রি করতে হবে অথবা নন-মার্জিন হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে।

তা ছাড়া শতভাগ মার্জিন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকলে কেউ ১ অনুপাত ১ ঋণ পাবেন না। সে ক্ষেত্রে ওই বিনিয়োগকারী ১ অনুপাত দশমিক ৫ হারে ঋণ পাবেন। হাউজগুলোর বিবেচনার আলোকে শুধুমাত্র ১০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ যাদের থাকবে তারাই ১ অনুপাত ১ ঋণ পেতে পারেন।

সিকিউরিটিজ ছাড়া অন্য ইনস্ট্রুমেন্টগুলো (যেমন বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ড) মার্জিন ঋণ পাবে না।

উল্লিখিত বিষয়গুলোই বিনিয়োগকারীদের মাঝে তৈরি করেছে আতঙ্ক যা বিক্রয়চাপে রূপ নিয়ে গত কিছু দিন থেকে পুঁজিবাজারের টানা দরপতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএসইসির এ সংশোধনী প্রস্তাবে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারের জন্য কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও আবার কিছু কিছু বিনিয়োগকারী যৌক্তিক বলে মেনে নিতে পারছেন না। যেমন বাজারে বর্তমানে মৌলভিত্তির দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর যে শেয়ারদর তাতে বহুজাতিক কোম্পানি তো দূরের কথা দেশীয় বেশ কয়েকটি ভালো কোম্পানিও ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে। যেমন বর্তমান বাজার দর বিবেচনায় নিলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বিএটিবিসি, লিন্ডে বিডি, বাটা স্যু, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মতো কোম্পানিগুলো এমনকি জ¦ালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত তৈল বিপণন কোম্পানিগুলোও এ ঋণ সুবিধা পাবে না।

তবে এর মাধ্যমে বাজারে যে ইতিবাচক ধারা তৈরি হবে তা হলো যেসব কোম্পানি ভালো পারফর্ম না করেও নামমাত্র লভ্যাংশ ঘোষণা করে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে লেনদেনের মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটার প্রবণতায় কিছুটা হলেও লাগাম টানা সম্ভব হবে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির কারণেই প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।

এ দিকে, সংশোধনী প্রস্তাব দেয়ার সাথে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের এ বিষয়েও আশ^স্ত করেছে যে মার্জিন রুলস সংশোধনের এ প্রক্রিয়া এক দিনেই কার্যকর করা হবে না। এর জন্য বিনিয়োগকারীদের ১২ থেকে ১৮ মাস সময় দেয়া হবে, যাতে তারা উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ঋণ সমন্বয় করতে পারেন।

বিএসইসি বলছে, এ সংশোধনী পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়েই করা হচ্ছে। বাজারে অস্থিরতা তৈরি এ উদ্দেশ্য নয়। একটি স্বচ্ছ ও টেকসই পুঁজিবাজার তখনই সম্ভব যদি অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমাদের পুঁজিবাজার যে অনিয়মগুলোর কারণে মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়েছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তা থেকে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করা যাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করে স্বস্তি পায়।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ মনে করছে বিএসইসির এ উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারকে টেকসই করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন, যাতে বিনিয়োগকারীরা বিষয়টি আত্মস্থ করে নিতে পারে।