বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন করতে এবং ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্ত রাখতে বেশ কায়দা করে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মামলার ধরন, আইনের বিকৃতিকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনার বিশ্লেষণ করে গুম কমিশন দেখিয়েছে কিভাবে আজ্ঞাবহ আদালত আইনের মৌলিক ভিত্তি ও প্রক্রিয়া পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধীদের অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করার বৈধতা দিয়েছে।
ভয় দেখিয়ে জোর করে স্বীকৃতি আদায় : বিভিন্ন সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বছরের বছর দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করা হয়েছে। এসবের মধ্যে অসংখ্য অসংলগ্নতা, নিয়মের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়। সাক্ষীদের নানা ভয়ভীতি দেখানোটা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তাদের পরিষ্কারভাবে বলা হতো যে, যদি ১৬৪ ধারায় তাদের শিখিয়ে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী না দেয় তবে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। বছরে পর বছর এমন নিপীড়নমূলক আচরণ করা হতো বিভিন্ন বাহিনীর হাতে আটক ব্যক্তিদের সাথে। মৌখিক ভয় দেখিয়ে কাজ না হলে গোপন জায়গায় আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানো হতো। গুম জীবন দীর্ঘায়িত হওয়া এবং মৃত্যুর ভয়ে তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হতো অথবা নিজেই দায় শিকার করে নিতো। ভয় দেখিয়ে কাজ না হলে পরিবারের সদস্যদেরও ক্ষতি করা হতো নানা রকম নির্যাতনের মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যারা শিখিয়ে দেয়া বর্ণনা দিতে অস্বীকার করেছে বা সময় নিয়েছে তাদের অনেককেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে অথবা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো কঠিনভাবে সাজানো হতো।
উদাহরণস্বরূপ : ৩২ দিন নিখোঁজ থাকা ২৭ বছর বয়সী একজন জানান, আমাকে সারা রাস্তায় বলে রাখছে, তুই যদি উল্টাপাল্টা করিস বা ১৬৪ না দিস তবে তোর ওয়াইফকে নিয়ে আসব। তোকে ইচ্ছামতো মারব.... আমাদের এখানে কোনো রুলস নাই বা কেউ কিছু করতে পারবে না।
২০১৭ সালে র্যাবের হাতে অপহৃত হয়ে ২০৮ দিন গুম থাকা ২৮ বছর বয়সী একজন জানান, চার মাস পরে আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে বলতেছে, তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও, নাকি এভাবেই জীবন শেষ হয়ে যাবে? আমি বললাম, অবশ্যই আমি এখান থেকে বের হতে চাই। তখন বলে, ঠিক আছে, তাহলে আমরা যে কথাগুলো বলব, তুমি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাই বলবা। ... যদি তুমি এটা বলো তাহলে তুমি এখান থেকে বের হতে পারবে। আর যদি না বলো তবে এখানে তোমাকে ক্রসফায়ারে দিব, তুমি মরবা।
২০২০-এ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) হাতে তিন দিন গুম থাকা ১৮ বছর বয়সী এক কিশোরকে কাগজে লিখে দিয়ে বলা হয়, তুমি এইভাবে সব স্বীকারোক্তি দিবা। না হলে তোমাকে বাঁচায় রাখব না, মেরে ফেলা হবে। আমি প্রথমবার দিতে চাইছিলাম না, তখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আইনজীবীকে ডাক দিয়ে বললেন, আপনাদের আসামি তো ভালো করে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে না।
এরপর ওনারা আমাকে বাইরে নিয়ে শাসায়। তখন আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম, স্যার, আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে যেতে দেন। ভাইয়ের জন্য, মায়ের জন্য মনটা কাঁদছে।
লিখে দেয়া জবানবন্দী মুখস্থ করানো হতো : অনেক আটককৃত বা অপহরণ করা ব্যক্তিদের গোপন আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হতো এবং তাদের হাতে আইনকর্মকর্তাদের দ্বারা লিখিত কাগজ ধরিয়ে দিয়ে মুখস্থ করতে বলা হতো। এরপর তা তাদের শোনাতে হতো। মুখস্থ হলে ম্যাজিস্ট্রেটদের সামনে এমনভাবে বলতে হতো যেন আমি সব নিজ থেকে স্বেচ্ছায় বলছি। ৪৫ বছর বয়সী একজন, যাকে সিটিটিসি অপহরণ করে চার দিন গুম করে রেখেছিল তিনি বলেন, বিভিন্ন জিনিস লেখাইছে, পড়াইছে, মুখস্থ করাইছে, বলছে এগুলি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলবি না হলে যতবার খুশি রিমান্ডে নিব।
২৭ বছর বয়সী একজন, যিনি র্যাবের হাতে ১১৩ দিন গুম ছিলেন, তিনি বলেন, আমাকে শেষে চার-পাঁচ দিন সময় দিযে বলেছে যে, এটা মুখস্থ করবা, এই কথাগুলাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলবা। না বললে আরো চার পাঁচটা মামলা দিয়া দিব। আর ঠিক মতো বললে মামলা ছোট করে দিমু।
৪৪ দিন গুম থাকা একজন বলেন, তারা আমারে আগে থেকে ফরমেট সারারাত পড়াইছে। এরপর বলছে, সকালবেলা এইটা বলবা। কোর্টে যাবা, যা যা জিজ্ঞাসা করুক তুমি এটাই বলবা। কিন্তু আমি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বললাম, স্যার আমি আপনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। তাকে যখন আমি বলছি, স্যার আমি এগুলো করি নাই। এরা আমারে মারধর করে জোর করে এগুলা বলাইছে। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। কিন্তু তারপরেও সে আমার বিপক্ষে লিখছে। তারা আমারে অনেক দিন আটকে রাখছিল কারণ তাদের পছন্দ মতো ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না।
কোনো আইনি সহায়তা ছিল না : অধিকাংশ সময় সাক্ষীদের যখন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনা হতো তখন তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী থাকত না। কোনো পরামর্শক ছাড়াই তাদেরকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে আনা হতো। আইনজীবী থাকলে তাদের দিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেয়া সম্ভব হতো না। ১৩ দিন গুম থাকা একজন বললেন, আমাকে জজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কোনো উকিল আছে কি না? আমি বললাম, আমাদের এখানে গুম অবস্থা থেকে সরাসরি নিয়ে এসেছে, উকিল পাব কোথায়।... তো জজ সাহেব তার পরও চার দিন রিমান্ড মনজুর করলেন।
র্যাবের হাতে ৩১৫ দিন অপহৃত থাকা ২০ বছর বয়সী বলেছে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের তো উকিল নাই, আপনাদের কিছু বলার আছে কিনা। বললাম, জি স্যার আছে, আমাদের রিমান্ড কিভাবে হয়? আমরা তো সেখানে ছিলামই না।
আমরা যখন গুমের পুরো ঘটনা বলি তখন তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যান। ম্যাজিস্ট্রেট যখন পুলিশের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইল তখন চট্টগ্রামের একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন, বললেন, স্যার ওরা ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তাই এভাবে বলতে পারতেছে। ওরা যদি গুমে তাকে তবে ওদের মোচ কাটা কেন? অথচ ওরা আমাদের কোর্টে হাজির করার আগে মোচ কাটিয়ে, পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে আনে। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদের তিন দিনের রিমান্ড মনজুর করেন।
বিচারকরাও অসহায় ছিলেন অনেক সময় : বহুক্ষেত্রে দেখা যায় বিচারকরা ন্যূনতম আইনি বাধ্যবাধকতা মানা না হলেও পুলিশের বা রাষ্ট্রপক্ষে আবেদনে সাড়া দিতে বাধ্য হতেন। এমনভাবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করা হতো যেন আসামিরা সবাই স্বেচ্ছায় সব বলছেন। আসামিরা যতই বলতেন যে, আমাদের অত্যাচার করা হয়েছে লাভ হতো না। তাদের স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেযা হতো না। অনেক ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের কথাই শুনতে চাইতেন না। তারা অনেকটা রাবার স্ট্যাম্পের মতো কাজ করতেন।
সিটিটিসির হাতে ২৮ দিন গুম থাকা একজন বলেন, আমারে মাইরা ১৬৪ করছিল। আমার হাত বাঁধা, দুইটা হাতই বাঁধা। ম্যাজিস্ট্রেট আমারে জিজ্ঞাস করতেছে আর লিখতেছে। একবার জানতে চাইল আপনার বাসায় লাইব্রেরি আছিল? আমি বলছি, আমার বাসায় বই ছিল, লাইব্রেরি ছিল। তো আপনারা কি সেখানে বসে আড্ডা দিতেন। আমি বললাম মাঝে মধ্যে ওরা আসত, গল্প করতাম। তো সেখানে লেখা হলো, ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে লেখা, আমি জিহাদি কর্মকাণ্ডে জড়িত। আমি তো তাকে এই কথা বলি নাই।
এই রকম আরো অনেককে র্যাব, পুলিশ অপহরণ করে নিয়ে জোর করে বিচারকের সামনে হাজির করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ইচ্ছামতো লিখিয়ে নিত।
একই আইনের অধীনে অভিযোগ আবার অভিযোগেও মিল : ১৯৮টি মামলা পাওয়া যায় এন্টি টেরোরিজম অ্যাক্ট ২০০৯এ। বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪ অনুসারে মামলা দেয়া হয় ৫১টি। ৪৩টি মামলা দেয়া হয় অস্ত্র আইন ১৮৭৮ অনুযায়ী। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ অনুসারে ছিল ৯টি মামলা।
অসংখ্য মামলার অভিযোগ একইভাবে লিখিত। পড়লেই বোঝা যায় এসব সাজানো। অনেক মামলায় দেখানো হয় আসামিরা রাষ্ট্রের জন্য, জাতীয় নিরাপত্তার হুমকিস্বরূপ। বেশির ভাগ জায়গায় বলা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে। অভিযোগে বলা হয়, ফেসবুক আইডি থেকে সরকারবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অথবা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অসত্য ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। অথবা সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে, জনমনে বিরূপ ধারণার তৈরি হয় এমন বক্তব্য প্রচার করে। কোথায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে বলা হয়, জিহাদি বই পাওয়া গেছে অথবা জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য গোপন বৈঠক করছিলেন।
এ রকম নানাভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি নাটক সাজানোর জন্য নিরপরাধ সরকারবিরোধী মতাদর্শের লোকদের অপহরণ করে গুম করে রাখা হতো। এরপর তাদের ওপর নানা অত্যাচার চালানো হতো মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। আইন ও বিচারের ন্যূনতম নিয়মনীতি অনুসরণ করা হতো না। এভাবেই কেটেছে শেখ হাসিনার ১৫ বছর।