গোয়েন্দা প্রতিবেদনের খপ্পরে সরকার

আ’লীগ সংশ্লিষ্টদের ভালো পদায়নে সমালোচনার সৃষ্টি

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস ও মিশনে কর্মকর্তা নিয়োগে সতর্ক থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার আগে প্রার্থী বাছাইয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, শৃঙ্খলার বিষয়ে, বিভাগীয় মামলার বিষয়ে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করার কথাও বলা হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের পরও প্রার্থী বাছাইয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের খপ্পরে পড়ছে সরকার। প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্যের সন্তানের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাচ্ছে না গোয়েন্দারা। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের সমর্থক না হওয়ায় জনপ্রশাসনে পদায়ন না হওয়া এবং পারিবারিকভাবে আওয়ামীবিরোধী কর্মকর্তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এমন কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে শেখ হাসিনার কয়েকজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তাকে সরকার বিভিন্ন দেশে পদায়ন করে। চিহ্নিত এসব আওয়ামী কর্মকর্তাকে লোভনীয় পদায়ন করায় প্রশাসনে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তাই এমন বিতর্কিত পদায়ন রোধ করতে জনপ্রশাসন থেকে বিদেশে কর্মকর্তা পদায়নে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার আগেই প্রার্থী সম্পর্কে বিভাগীয় মামলা, দুদক ও গোয়েন্দা সম্পর্কিত প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দেয়া হয়। এর পরও বিতর্কিত পদায়ন বন্ধ হচ্ছে না।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৭ জন কর্মকর্তাকে বদলিপূর্বক বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাঁরা শ্রমবিষয়ক মিনিস্টার, কাউন্সেলর ও প্রথম সচিব পদে দায়িত্ব পালন করবেন।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) কর্মকর্তাদের মধ্যে যুগ্মসচিব থেকে শুরু করে সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলিপূর্বক নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের চাকরি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে।

নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৭ কর্মকর্তার মধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন।

প্রজ্ঞাপনের ১৭ নম্বরে প্রথম সচিব (শ্রম) বাংলাদেশ হাইকমিশন, বুখারেষ্ট, রোমানিয়ায় পদায়ন করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের উপপরিচালক এএইচ ইরফান উদ্দিন আহমেদ। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩৩ ব্যাচের এই কর্মকর্তার পিতার নাম হারিছ উদ্দিন আহমেদ। গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ ও পরবর্তীতে যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন হারিছ উদ্দিন আহমেদ। এরপর আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য এবং গাজীপুর আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন।

এই কর্মকর্তার পিতার আওয়ামী রাজনীতিতে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার থাকলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তা গোপন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রার্থীর পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়ব্যক্তির ছাত্রজীবনে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বর্তমানে তিনি রাজনৈতিকভাবে দল নিরপেক্ষ। বিষয়ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে তিনি দলনিরপেক্ষ। বিষয়ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।’

তালিকার ১৫ নম্বরে থাকা ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বেলাল হোসেনকে পদায়ন করা হয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন মিসরের কায়রোর প্রথম সচিব (শ্রম) হিসেবে। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা যোগদানের পরই ছাত্রলীগের সুপারিশে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পদায়ন নেন। এরপর সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে নরসিংদীর বেলাবো উপজেলায় এবং নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার, টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

এই কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত এবং বর্তমানে ভারতে বসে দেশবিরোধী চক্রান্তে জড়িত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানীর নিকটাত্মীয় হওয়ার পরও তার কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

এই কর্মকর্তার বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রার্থীর পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়ব্যক্তির ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি রাজনৈতিকভাবে দলনিরপেক্ষ। বিষয়ব্যক্তির পিতা ও আপন এক মামা বিএনপি মতাদর্শী। তার আপন এক চাচা আওয়ামী লীগ মতাদর্শী।’

তালিকার দুই নম্বরে রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্মসচিব মিজ জুবাইদা মান্নান। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা মিনিষ্টার (শ্রম) বাংলাদেশ দূতাবাস, মাস্কাট, ওমান এ পদায়ন পেয়েছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সাথে জননিরাপত্তা বিভাগে প্রায় তিন বছর কাজ করেছেন। এর আগে ছয় বছর মিসরের কায়রো দূতাবাসের প্রথম সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এর আগে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরা, এডিসি নারায়ণগঞ্জ হিসেবে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশে পদায়ন থাকলেও এই কর্মকর্তার বা তার পরিবারের নিকটাত্মীয়দের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য পায় না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

তার বিষয়ে দেয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রার্থীর পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ছাত্রজীবনে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বর্তমানে তিনি রাজনৈতিকভাবে দল নিরপেক্ষ।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থায় গত ১৬ বছরে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়োগ দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পরও সাবেক ছাত্রলীগের সেই নেতাকর্মীরা বহালতবিয়তে রয়েছেন। এমনকি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গাতেও আগের কর্মকর্তারা বহাল রয়েছেন। এসব কর্মকর্তাই পদোন্নতি পদায়নের গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত থাকছেন। ফলে তারা আওয়ামী কর্মকর্তাদের রক্ষা করে দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা বলে প্রতিবেদন দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রমবিষয়ক মিনিস্টার পদে মৌখিক পরীক্ষায় ডাক না পাওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ না হওয়ায় চাকরিজীবনে জেলা প্রশাসক বা ঢাকার আশপাশে কোনো জেলায় পদায়ন পাইনি। পরিবারেও আওয়ামী লীগের কোনো সমর্থক নেই। নিজে আওয়ামী লীগ সমর্থন করার তো প্রশ্নই আসে না। একবার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জনপ্রশাসনে পদায়নের চেষ্টা করলে ব্যাচের সেই সময়ের নেতৃবৃন্দ আমি আওয়ামী পন্থী না বলে পদায়নের সেই ফাইল তুলতেই পারেনি। এরপর এবার শুনলাম একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আমাকে আওয়ামী পন্থী কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিবেদন দিয়েছে।

এই কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কঠোর আওয়ামী বিরোধী পরিবারের সন্তান হয়ে, নিজে সারা জীবন আওয়ামী লীগকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেও শুধু একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে আমি আজ আওয়ামী পন্থী অফিসার হয়ে গেলাম। অথচ যারা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছে, পরিবার সারা জীবন আওয়ামী লীগ করেছে তাদের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় না বা দলনিরপেক্ষ হয়ে যায়। এই সব আওয়ামী পন্থী গোয়েন্দা অফিসারদের রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সৎ ও দলনিরপেক্ষ যোগ্য অফিসারদের প্রতি অন্যায় করা হবে।