ভূমিকম্প থামলেও আতঙ্ক কাটেনি

আবার কখন ভূমিকম্প হয় এ আশঙ্কায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। তাদের ভাষ্য গতকালের মতো ভূমিকম্প তারা কখনো অনুভব করেননি। সামনে যদি তার চেয়ে বেশি কম্পন হয় তবে অবস্থা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।

আবুল কালাম
Printed Edition
ভূমিকম্পে শনির আখড়া এলাকায় ভবন কাত হয়ে যায়
ভূমিকম্পে শনির আখড়া এলাকায় ভবন কাত হয়ে যায় |নয়া দিগন্ত

ভূমিকম্প থামলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থামেনি। আবার কখন ভূমিকম্প হয় এ আশঙ্কায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। তাদের ভাষ্য গতকালের মতো ভূমিকম্প তারা কখনো অনুভব করেননি। সামনে যদি তার চেয়ে বেশি কম্পন হয় তবে অবস্থা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।

বিরাজমান অবস্থায় পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলছেন, পুরান ঢাকার প্রায় ৯০ ভাগ পুরনো ভবন তৈরি হয়েছে বিল্ডিং কোড না মেনে। ফলে পুরান ঢাকা ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলছেন, বাংলাদেশের পটভূমিতে ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতায় এটি হলো এ যাবৎ কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৩ সালে রাঙ্গামাটিতে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি বরকল ইউনিয়নে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এটিও অনেক শক্তিশালী ছিল। তবে ১৯১৮ সালে দেশের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা সরকারকে বারবার বলে আসছি ভূমিকম্পে মহড়ার বিকল্প নেই। সরকার ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকার্যের জন্য কোটি কোটি টাকার বাজেট রাখে, সেখান থেকে দুর্নীতি করতে পারে। কিন্তু যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।

অন্য দিকে আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা এবং এর আশপাশে বিগত কয়েক দশকে সংঘটিত ভূমিকম্পের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ মাত্রার। যা প্রমাণ করে যে, এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং এতে করে যেকোনো সময় বাংলাদেশে আরো বড় ভূমিকম্প হতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদী।

বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদি আহমেদ আনসারীর ভাষ্য, এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতায় আরো বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কা অনেক দিন ধরেই ছিল। তিনি জানান, মাত্রা যদি ৬ এর কাছাকাছি পৌঁছায় তাহলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিশেষজ্ঞদের এমন আশঙ্কায় মানুষের ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। তারা বলছেন ভবন নির্মাণে আমাদের দেশে নিয়মনীতির তেমন কোনো তোয়াক্কা হয় না। তাই এটা সহজ যে বড় ভূমিকম্পে ভয়ানক বিপর্যয় নামবে। কারণ এমনিতেই বর্তমান অবস্থায় দেশে একটি ভবনও ধসে পড়লে আমাদের দেশে মানুষ উদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেখানে ভূমিকম্পে যে সরকার চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এদেশে মানুষের জীবনটা সব সময় অনিশ্চিত মন্তব্য করে তারা বলেন, গতকালে দিনটা এমন হবে কে জানতো। আর যদি ভয়ানক কিছু হতো তবে কী অবস্থা হতো।

ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই দেখেন গতকাল সকাল থেকে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দিনটি আতঙ্কের দিন হিসেবে আমাদের জীবন স্মৃতিতে জায়গা করে নিলো। গতকালের ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে দিয়ে তিনি বলেন, ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মুহূর্তেই প্রাণ রক্ষার চেষ্টায় সবাই পেরেশান হয়ে উঠল। সর্বত্রই ভেসে আসছিল মানুষের আকুতি। ঘর ছেড়ে মানুষ আতঙ্কে দিনভর রাস্তায় অবস্থান নেন। আতঙ্কে কান্নায় ভেঙে পড়েন কেউ কেউ।

তার কথা শেষ না হতেই পাশে অবস্থানরত দিলরুবা ভয়ে কাঁপছিলেন। ভূমিকম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন, আল্লাহ কিভাবে বাঁচিয়েছেন জানি না। ৭তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ভূমিকম্প থেমে গেছে এমনটা তার খেয়াল ছিল না। তার ভাষ্য, তখন তিনি ড্রয়িংরুমে বসা ছিলেন। পাশে ছিল তার সন্তান। হঠাৎ মনে হলো ভবন কাঁপছে। কিছু বুঝার আগেই প্রচণ্ড ঝাঁকি এতটুকুই তার মনে আছে। এরপর নিজেকে রাস্তায় আবিষ্কার করলেন। বললেন জীবনে এমনটা এই প্রথম। সামনে কী হয় সেই আতঙ্ক এখন তাকে তাড়া করছে।

একই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন শরিফুল আলম। বললেন ‘ভাই ক্যামনে কী হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। এখন ঘরে যাওয়ার সাহস নেই। রাতে ঘুমাবো কিভাবে তা নিয়ে ভয়ে আছি।’ নবম শ্রেণীর কিবরিয়া ভয়ে কাঁপছিল। জানালো সে মোবাইল দেখছিল। হঠাৎ ঝাঁকুনি অনুভব করার সাথে সাথে ঘরের সবাই চিৎকার দিয়ে ওঠেন। সাথে সাথে দরজা খুলে সবাই সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসেন। আর কিছু মনে নেই। তাদের ভাষ্য এমতাবস্থায় যদি আরো বড় ভূমিকম্প হয় তবে তা কিভাবে মোকাবেলা হবে তা নিয়ে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে ভয়ানক বিপর্যয় হবে।