ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যয় বেশি ভারতের চেয়েও

ইতোমধ্যে খরচ বেড়েছে প্রায় ৬৫২ কোটি টাকা। এখানে প্রতি মাসে জনপ্রতি পরামর্শক ব্যয় প্রায় ১১ লাখ টাকা।

হামিদ সরকার
Printed Edition
নির্মাণাধীন ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে
নির্মাণাধীন ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে |সংগৃহীত
  • ৬ বছরের প্রকল্প সাড়ে ৭ বছরে ৫৫ শতাংশ
  • খরচ বেড়েছে প্রায় ৬৫২ কোটি টাকা
  • জনপ্রতি মাসে পরামর্শক খরচ ১০.৭৬ লাখ টাকা
  • বাণিজ্যিক চুক্তি করতেই ৪ বছর অতিক্রম

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেয়া বড় প্রকল্পগুলো এখন সরকারের গলার কাঁটা। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি তার একটি। সাড়ে সাত বছরে এর কাজ হয়েছে মাত্র ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ শতাংশ পিছিয়ে আছে। এখানে প্রকল্পটি প্রায় ছয় বছরে শেষ করার কথা ছিল। তার ওপর প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ খরচ ভারতের চেয়ে এখানে অনেক বেশি। ভারতে এলাকাভেদে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে এক থেকে আড়াই কোটি ডলার হলেও বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ডলার। এখন ১০ বছরে প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি। যে হারে আগাচ্ছে তাতে কাজ শেষ করাটাই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। ইতোমধ্যে খরচ বেড়েছে প্রায় ৬৫২ কোটি টাকা। এখানে প্রতি মাসে জনপ্রতি পরামর্শক ব্যয় প্রায় ১১ লাখ টাকা। বিলম্বের কারণ হিসেবে সেতু বিভাগ বলছে, বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর বাণিজ্যিক চুক্তির প্রায় চার বছর পর, অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার সাথে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান টিএমএসএর কনসালটিং লিমিটেড বলছে, প্রকল্প অফিসের অর্থবছর ভিত্তিক পরিকল্পনায় দেখা যায় মূল ডিপিপির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

সেতু বিভাগের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক, শিল্প ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলোর সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের ৩০টি জেলার সংযোগ স্থাপন, যানজট নিরসন, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক ও জাতীয় মহাসড়কের সাথে সংযুক্তি, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে সংযোগ এবং আমদানি-রফতানি ব্যবসা সম্প্রসারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির লক্ষ্যে ‘ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রকল্পের মূল ডিপিপি ২৪ অক্টোবর ২০১৭ সালে ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, প্রকল্পের প্রাইস কন্টিনজেন্সি বৃদ্ধি, ট্যাক্স/ভ্যাট, বেতন, ভাতা, সম্মানী, আউটসোর্সিং স্টাফ, জ্বালানি, লুব্রিকেন্ট, স্টেশনারি, যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে প্রকল্প সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই অনুযায়ী, প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপি ১ জুন ২০২২ সালে ব্যয় বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মেয়াদ জুন ২০২৬ মেয়াদ বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। ফলে মূল ডিপিপির তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৬৫১ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ৩.৮৫ শতাংশ।

মূল কাজগুলো : প্রকল্পের আওতায় ৪০.৮৯ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসন, ২৪ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ১০.৮৪ কিলোমিটার র‌্যাম্পস, ১.৯২ কিলোমিটার নবীনগর ফ্লাইওভার নির্মাণ, ১৪.২৮ কিলোমিটার চার লেনের এটগ্রেট সড়ক পুনর্নির্মাণ (২ লেন+২ লেন সার্ভিস রোড), ২.৭২ কিলোমিটার দুই লেন সেতু নির্মাণ, ৫০০ মিটার ওভারপাস বা ফ্লাইওভার নির্মাণ, ১৮ কিলোমিটার ইউটিলিটির জন্য ড্রেনেজ এবং ডাক্ট নির্মাণ এবং পাঁচটি টোল প্লাজা নির্মাণ ইত্যাদি।

ভারতের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা : প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, ভারতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ খরচ বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে। তবে এটি সাধারণত এক থেকে আড়াই কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে। দিল্লি-মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ের মতো কিছু প্রকল্পের খরচ প্রতি কিলোমিটারে দেড় কোটি ডলারেরও বেশি ছিল। তবে, অন্যান্য এক্সপ্রেসওয়ের খরচ কমও হতে পারে। আর বাংলাদেশে চলমান ঢাকা-আশুলিয়া প্রকল্পের খরচ শুধু এক্সপ্রেসওয়েতে ২৪ কিলোমিটারের জন্য ৮ হাজার ৪২২ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। ফলে এখানে কিলোমিটারে ব্যয় ৩৫০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা ১২০ টাকা হিসেবে ডলার ধরলে দুই কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এর আগে রামপুরা-ডেমরা প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রতি কিলোমিটারে ২৪৪ কোটি টাকা। ওই প্রকল্পের করচ ছিল তিন হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। আর ঢাকা-মাওয়া প্রকল্পে খরচ হয় এক কোটি ১৯ লাখ ডলার।

সাড়ে ৭ বছরে প্যাকেজ ভিত্তিক অগ্রগতি : প্রকল্পে মোট পাইল সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪০টির মধ্যে কাজ হয়েছে তিন হাজার ৯৫১টির, যা মোট কাজের ৭৮.৪০ শতাংশ। প্রকল্পে পাইল ক্যাপের সংস্থানে আছে এক হাজার ৩৭৭টি, যার মধ্যে কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৮১টি। কাজের অগ্রগতি ৭১.২০ শতাংশ। আর পিয়ার কলাম বিদ্যমান প্রকল্পে মোট দুই হাজার ৪৭টি। কাজ সম্পন্ন হয়েছে এক হাজার ৩৫৫টি, যা উক্ত কাজের ৬৬.২০ শতাংশ। প্রকল্পে মোট এক হাজার ২১৯টি পিয়ার ক্যাপের মধ্যে ৬৩৫টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যা উক্ত কাজের ৫২.১০ শতাংশ। প্রকল্পে মোট ৯ হাজার ৬৩টি গার্ডার ফেব্রিকেসন-এর মধ্যে কাজ হয়েছে তিন হাজার ৩৮৯টির, যা উক্ত কাজের মাত্র ৩৭.৪০ শতাংশ। টি-গার্ডার ইরিকশন মোট ৯ হাজার ৬৩টি। এর মধ্যে মাত্র তিন হাজার ১০৭টির কাজ হয়েছে, যা কাজের মাত্র ৩৪.৩০ শতাংশ। র‌্যাম্প নির্মাণ ১০.৮৪ কিলোমিটার প্রকল্পের ছয়টি র‌্যাম্পের গার্ডার ইরিকশন ও পিয়ারের কাজ চলমান আছে। বিদ্যমান প্রকল্পে ১৪.২৮ কিলোমিটার সড়ক পুনর্নির্মাণের সংস্থান রয়েছে। বর্তমানে রাস্তার আইএসজি, সাববেস ও গেসবেস টাইপ-১ এর কাজ চলমান আছে। আর টোল প্লাজা চারটির এখনো শুরু হয়নি।

পৌনে ১০ বছরেও শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা : প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের মেয়াদ এক হাজার ৮৮৬ দিন বা পাঁচ বছর দুই মাস। প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে ডিসেম্বর ২০২৭ এর মধ্যে। প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল ৩০ জুন ২০২৬। তবে ঋণচুক্তি বিলম্বিত হওয়ায় ডিপিপি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। তাই অবশিষ্ট নির্মাণ কাজ প্রকল্প মেয়াদে অর্থাৎ জুন ২০২৬ এ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পে চাহিদানুযায়ী অর্থ বরাদ্দ, অর্থ ছাড় করা হলেও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।

কাজের অগ্রগতি মন্থর : প্রাপ্ত তথ্য থেকে কাজের অগ্রগতিতে দেখা যায়, প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত বাস্তব কাজের লক্ষ্যমাত্রা ৬৮ শতাংশ নির্ধারিত থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৫৫ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। তবে আর্থিক অগ্রগতি ৯ হাজার ৬৬৫ কোটি ৫৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, যা অর্থ ছাড়ের ৯৪.৫২ শতাংশ।

অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তি : আইএমইডির নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান টিএমএসএল কনসালটিং লিমিটেড বলছে, প্রকল্পে মোট ১৫টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। ১৫টি অডিট আপত্তির মধ্যে ইতোমধ্যে (১৫ নং আপত্তি) একটি আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। ১৪টি আপত্তি অনিষ্পন্ন রয়েছে। অনিষ্পন্ন ছয়টি আপত্তির সাথে ১৩ কোটি ৬৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জড়িত। আপত্তিসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে যেসব প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে, সেসব প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও ইউটিলিটি স্থানান্তর আগেই সম্পন্ন করা হলে সময় ও অর্থ উভয়ই সাশ্রয় হবে।