জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংস্কার ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, উচ্চকক্ষে ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর), রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উভয়কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোট এবং পিএসসি, দুদক, সিএজি ও ন্যায়পাল নিয়োগের সাংবিধানিক বিধান অন্তর্ভুক্ত করার মতো সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে কমিশন। তবে এসব সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিলতা বাড়ছে।
বিএনপি বলছে, নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক পরিবর্তনের ক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই, বরং নির্বাচিত সংসদের প্রথম দুই বছরে সংস্কার কার্যক্রম হওয়া উচিত। কিন্তু বেশির ভাগ দল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত মডেল অনুসরণে অনড়। ফলে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও, বাস্তবায়ন ঘিরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও আইনি সঙ্ঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ২৩তম দিনের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
উচ্চকক্ষে পিআর : বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষে (১০০ আসন) ভোটের আনুপাতিক হারে (পিআর) প্রতিনিধি মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে কমিশন। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর মোট ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টিত হবে। তবে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও এলডিপি চাইছে নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দ হোক। তারা কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেবে বলে জানায়।
এ দিকে সিপিবি, বাসদ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম উচ্চকক্ষেরই বিরোধিতা করে এককক্ষীয় সংসদের পক্ষে মত দিয়েছে। বিপরীতে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ বেশির ভাগ দল উচ্চকক্ষে ও নারী আসনগুলোতেও পিআর পদ্ধতির দাবি জানিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : গোপন ভোটে উভয় কক্ষের সম্মতি : রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে কমিশনের সিদ্ধান্ত হলো, জাতীয় সংসদ ও উচ্চকক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি প্রার্থী কোনো রাজনৈতিক বা সরকারি পদে থাকলে নির্বাচন করতে পারবেন না, এ সংক্রান্ত শর্ত সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে।
সংবিধানে পিএসসি, দুদক, সিএজি ও ন্যায়পাল : কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এনডিএমসহ পাঁচটি দল এতে আপত্তি জানিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জুলাই সনদে আমাদের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার আইনের ঊর্ধ্বে।’ অপর দিকে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনপূর্ব সাংবিধানিক সংস্কারের দাবিতে অনড় রয়েছে। তাদের অবস্থান, ‘আইনি ভিত্তি না দিলে কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা’ করবে বলে হুঁশিয়ারি দেন ইসলামী আন্দোলনের ডা: মো: রেজাউল করিম তাহের।
কমিশনের সিদ্ধান্ত আগামী ৫ আগস্ট ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে তাতেও সমাধান নয়, বরং সঙ্কট গভীর হওয়ার পূর্বাভাস মিলছে রাজনৈতিক বলয়ে।
জুলাই সনদ আইন নয়, এটি জাতীয় ঐকমত্যের অভিপ্রায় : সালাহউদ্দিন
জুলাই সনদকে আইনি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে সংলাপের ২৩তম দিনের বিরতিতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমরা জনগণের সার্বভৌম এখতিয়ারের ভিত্তিতে এই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এটি আইনের ঊর্ধ্বে। এটা হলো ‘লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন অব দ্য পিপল’, জনগণের প্রত্যাশার শীর্ষ বিন্দু।” তিনি জানান, কমিশনের প্রেরিত খসড়ায় কিছু ভাষাগত অসঙ্গতি থাকলেও তা সংশোধন করে গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা একমত যে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনি ও সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা সেই অঙ্গীকার করছি।’
তিনি আরো জানান, কমিশনের প্রস্তাবিত মূলনীতিতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতির মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে কিছু দলের আপত্তির কারণে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে হবে।
আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদ মূল্যহীন : ডা: তাহের
সংলাপের শেষ দিনে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদ মূল্যহীন। প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থাকলে এটি বাস্তবায়নযোগ্য হবে না। আমরা চাই এই সরকারের মেয়াদেই এর আইনি কার্যকারিতা শুরু হোক। না হলে কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করব।’ তিনি বলেন, ‘আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদে সই করার অর্থ নেই। সই করার পর যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে তা এক ধরনের প্রহসনে পরিণত হবে।’
জামায়াত নেতা আরো জানান, ‘সংবিধান সংশোধনের উদাহরণ রয়েছে, বিকল্পও রয়েছে। আইনি ভিত্তি এখনই দেয়া সম্ভব। যারা বলছেন সম্ভব নয়, তারা জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন।’
উল্লেখ্য, জামায়াত দীর্ঘ দিন ধরেই উচ্চকক্ষসহ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের দাবিতে রয়েছে। তাহের বলেন, “গত ৫৪ বছরের অপসংস্কৃতির নিরসনে ‘লোয়ার হাউজ অব ইয়ার’ ও ‘আপার হাউজ অব পিয়ার’ প্রয়োজন। বিশ্বে প্রায় ৯০টি দেশে এ পদ্ধতি কার্যকর আছে।”
ঐকমত্য বাস্তবায়নের পদ্ধতি স্পষ্ট নয় : এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঐকমত্যের বাস্তবায়ন পদ্ধতি, যা এখনো পরিষ্কার নয়।’ তিনি জানান, “উচ্চকক্ষে সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোট নিশ্চিত করতে হবে। এক শতাংশ ভোট পাওয়া দলগুলোও একজন করে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি পাঠাতে পারলে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিস্তৃত হবে।”
আখতার হোসেন বলেন, ‘উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির প্রতিনিধিরাও বৈধ, কারণ বিশ্বব্যাপী উভয় পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্য। আইন পাসের আগে উচ্চকক্ষে বিস্তারিত আলোচনা এবং সংসদের বাইরে মতবিনিময়ের সুযোগ তৈরি হবে।’
প্রসঙ্গত, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের জন্য সংলাপ শেষপর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য এখনো কাটেনি।