ভুয়া অ্যাপ ও বিনিয়োগ প্রলোভনে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা

শেয়ারবাজারে হোয়াটসঅ্যাপে প্রতারণার ফাঁদ

শাহ আলম নুর
Printed Edition

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নাম ও লোগো ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক-ভিত্তিক প্রতারণা চক্র বিনিয়োগকারীদের প্রলোভনে ফেলছে। এসব প্রতারক চক্র ‘অস্বাভাবিক মুনাফার’ আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভুয়া অ্যাপস ও গ্রুপে যুক্ত করছে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নিবন্ধন ফি আদায়সহ শেয়ার কেনাবেচার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণক চক্র ‘হাই-নেট-ওয়ার্থ অ্যাকাউন্ট’ খোলার আহ্বান জানাচ্ছে মাত্র এক হাজার টাকা ফি দিয়ে। পাশাপাশি, অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ‘ডিএসইএক্সপ্রো’ এবং আইফোনে ‘ডিএসইএক্সপিআরও’ নামের ভুয়া অ্যাপস প্রচার করা হচ্ছে। এসব অ্যাপে দাবি করা হচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা ছাড়কৃত দামে শেয়ার কিনে দ্রুত লাভবান হতে পারবেন।

পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে প্রতারণার কৌশলও বদলাচ্ছে। আগে যেখানে টেলিফোন কল বা ই-মেইলের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টার্গেট করা হতো, এখন সেখানে সোস্যাল মিডিয়া ও ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপ যুক্ত হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মে একসাথে বিপুলসংখ্যক মানুষকে টার্গেট করা সহজ হওয়ায় প্রতারকরা এ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে। যদি কেউ এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অর্থ বিনিয়োগ করেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, প্রতারকরা সাধারণত ভুয়া নাম, ভুয়া লোগো এবং ভুয়া লেনদেনের কাগজপত্র ব্যবহার করে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের পুঁজিবাজারকে টেকসই ও নিরাপদ করতে হলে বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। ডিএসই ও সিএসই অনুমোদিত ব্রোকারেজ হাউজ ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে লেনদেনের চেষ্টা মানেই ঝুঁকির মধ্যে যাওয়া। প্রতারক চক্র যতই প্রলোভন দেখাক না কেন, বৈধ প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিনিয়োগ করা উচিত নয় বলে তারা মনে করেন

ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বাজারে ৩৬১ টাকায় লেনদেন হওয়া জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার ২৪৫ টাকায় সাবস্ক্রিপশনের সুযোগ দেখানো হয়। ২৬ আগস্ট বিক্রির শর্তে ৪৭.৩৫ শতাংশ ভাসমান মুনাফার প্রলোভন দেয়া হয়েছিল। একইভাবে, খান ব্রাদার্স পিপি উভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার ১১৫.৭০ টাকা বাজারমূল্যের বিপরীতে ৯৬ টাকায় সাবস্ক্রিপশনের অফার দেয়া হয়, যেখানে ২০.৫২ শতাংশ মুনাফার হিসাব দেখানো হয়। কিন্তু ডিএসইর নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার এভাবে সাবস্ক্রিপশন করা যায় না। কেবল রাইটস শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে সাবস্ক্রিপশন অনুমোদিত, আর ব্লক মার্কেটের লেনদেনও মূল বাজারমূল্যের ১০ শতাংশ-এর বেশি হেরফের হতে পারবে না।

তথ্যে দেখা ডিএসই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় ইতোমধ্যে অভিযোগ দায়ের করেছে। পাশাপাশি দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও প্রতারণার এই নতুন কৌশল মোকাবেলায় কাজ করছে। ডিএসইর দাবি, প্রতারণার এই চক্রকে শনাক্ত এবং আইনের আওতায় আনতে সক্রিয়ভাবে তৎপর রয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ডিএসইর অভিযোগে বিশেষভাবে ‘ডিএসইএক্সপ্রো’ এবং ‘ডিএসইএক্সপিআরও’ নামের অ্যাপগুলোর কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, প্রতারণামূলক গ্রুপগুলো সাধারণত বাজারে উত্থান বা স্থবিরতার সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখনই তারা অবাস্তব রিটার্নের লোভ দেখায়। আমাদের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটর করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধরনের অফার কেবল ক্যাসিনোতেই সম্ভব। এগুলোতে যারা ফাঁদে পড়বে, তারা প্রতারিত হবে। বিএসইসি ও ডিএসই যদি কড়াভাবে ব্যবস্থা না নেয়, হাজারো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ডিএসইর জনসংযোগ বিভাগের ডিজিএম শফিকুল রহমান জানান, ইতিমধ্যে ১০টিরও বেশি প্রতারণামূলক গ্রুপ শনাক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ভেতরের তথ্য জানার ভান তৈরি করে, অস্বাভাবিক লাভের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা। অথচ এসব অ্যাপ দিয়ে কোনো শেয়ার কেনাবেচা সম্ভব নয়। পুরোপুরি প্রতারণার জন্যই এগুলো বানানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আমরা কাজ করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করা হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কেউ যদি এসব প্রলোভনে পড়ে অর্থ হারান, তার দায় ব্যক্তিগতভাবেই বহন করতে হবে।

তথ্যে দেখা যায় একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চার স্তরের বিনিয়োগ ফান্ড ঘোষণা করা হয়। টিয়ার ১ : এআই কোয়ান্ট প্রারম্ভিক শান্তি ফান্ড ১০ হাজার টাকা জমায় তিন দিনে ১.৯৮ শতাংশ লাভ। টিয়ার ২ : এখানে এক লাখ টাকার বিনিয়োগে সাত দিনে ৪.৯৭ শতাংশ লাভ। টিয়ার ৩ : এখানে পাঁচ লাখ টাকার বিনিয়োগে ১৫ দিনে ১২.৭৫ শতাংশ লাভ। টিয়ার ৪ : এখানে ১০ লাখ টাকার বিনিয়োগে ৩০ দিনে ২৭.৯৯ শতাংশ লাভ।

এ দিকে ডিএসই ও বিএসইসি উভয়েই জানিয়েছে, এসব ফান্ড তাদের জানা নেই। বিএসইসির এক কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদিত কোনো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এ ধরনের ফান্ড পরিচালনা করছে না। অর্থাৎ এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ এবং প্রতারণামূলক। ডিএসইর পক্ষ থেকে জাননো হয়েছে, কেবল অনুমোদিত ব্রোকারেজ হাউজ ও অফিসিয়াল ডিএসই মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা বৈধ। অস্বাভাবিক মুনাফার লোভে পড়ে কেউ ভুয়া অ্যাপ বা গ্রুপে যুক্ত হলে ক্ষতির দায় তাকে নিজেকেই নিতে হবে। বিএসইসি ও ডিএসই উভয় সংস্থা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। দ্রুত ধনী হওয়ার প্রলোভনে না পড়ে, যাচাই-বাছাই করে বৈধ প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করে নতুন ধরনের প্রতারণা কার্যক্রম শুরু করেছে একদল অসাধু চক্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ব্যবহার করে এসব চক্র নিজেদের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সম্পর্কিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে এবং কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করছে। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ।

তথ্যে দেখা যায় সম্প্রতি ডিএসইর নাম, ঠিকানা ও লোগো ব্যবহার করে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করেছে প্রতারকরা। এসব গ্রুপে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। ডিএসই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এসব গ্রুপে ডিএসইর সাথে সম্পর্কিত নয় এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছে। এভাবে অসচেতন বিনিয়োগকারীরা প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে অর্থ হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন। প্রতারকদের এ ধরনের কার্যক্রমে কেউ যেন প্রলুব্ধ না হন, সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছে দেশের প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান।

ডিএসই জানিয়েছে, শেয়ার বা সিকিউরিটিজ লেনদেনের একমাত্র বৈধ মাধ্যম হলো ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) অনুমোদিত ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান এবং ডিএসই মোবাইল অ্যাপ। এর বাইরে অন্য কোনো মাধ্যমে লেনদেন বৈধ নয়। তাই কেউ যদি ফোন কল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়, তবে সেটি প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।

প্রতিষ্ঠানটি আরো জানায়, এ বিষয়ে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ব্রোকারেজ হাউজ, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল), বিভিন্ন ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছে। একই সাথে ডিএসইর ওয়েবসাইটে সতর্কবার্তামূলক ব্যানার প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন।

ডিএসইর সতর্কবার্তায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ১. অনুমোদিত ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান বা ডিএসইর মোবাইল অ্যাপ ছাড়া অন্য কোথাও বিনিয়োগ করবেন না। ২. অতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভনে বিভ্রান্ত হবেন না। ৩. কোনো প্রকার সন্দেহজনক কল, বার্তা বা গ্রুপ সম্পর্কে দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান। ৪. নিজের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবসময় অফিসিয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে ডিএসই আরো বলেছে, ‘অসাধু চক্রের ফাঁদে পড়ে কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতারিত হবেন না। সবসময় জেনেবুঝে বিনিয়োগ করুন এবং প্রতারণা থেকে দূরে থাকুন।