বিশেষ সংবাদদাতা
- ভ্যাট ফাঁকির কারণে এক বছরে রাজস্ব ক্ষতি ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা
- করপোরেট ট্যাক্স ও ভ্যাট নিয়ে সিপিডির অনুষ্ঠান
বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী মনে করেন কর কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৭২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন কর কর্মকর্তারা ব্যাপকভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত। ওদিকে, ভ্যাট ফাঁকির কারণে এনবিআরের ক্ষতি বছরে এক লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
গতকাল ‘করপোরেট ট্যাক্স ও ভ্যাট সংস্কার : এনবিআরের জন্য ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে ওই জরিপের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপটি পরিচালনা করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী বর্তমান কর ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট।
জরিপে আরো দেখা গেছে, প্রায় পাঁচজন ব্যবসায়ীর মধ্যে চারজন কর কর্মকর্তার দায়বদ্ধতার অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া, ৮২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন দেশের কর ব্যবস্থা অসঙ্গতিপূর্ণ। এই জরিপটি ডিসেম্বর ২০২৪ সালে ১২৩টি কোম্পানির প্রতিনিধিদের উত্তর সংগ্রহের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মো: আবদুর রহমান খান, ঊর্ধ্বতন রাজস্ব কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী নেতা এবং অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠনে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির জন্য হারিয়েছে।
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামীম আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেটা করেছি, ইফেক্টিভ রেট (ভ্যাটের কার্যকর হার) বের করেছি, যেটা আসছে ১১.৭ শতাংশ। ‘সেটি দিয়ে আমরা দেখেছি, আমাদের একচুয়াল ভ্যাট আদায় কত আসা উচিত। মানে ভ্যাট আদায় যত হয়েছে সেটা বাদ দেয়ার পরেও সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকার মতো ফাঁকি দেয়া হয়েছে।’ গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআর আদায় করেছে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। তবে সে সময়ে ভ্যাট বাবদ তিন লাখ ২০ হাজার ১১৭ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে আসার ‘সম্ভাবনা’ ছিল। বাকি অর্থ কর ফাঁকি ও অব্যাহতির জন্য এনবিআর ‘হারিয়েছে’ বলে গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে।’
তিনি বলেন, দেশের ভ্যাট আইন অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করা হলেও বর্তমানে অনেক পণ্য ও সেবায় অব্যাহতি রয়েছে। সেসব হিসাব করে সিপিডি দেখিয়েছে, বর্তমানে ভ্যাটের কার্যকর গড় হার হলো ১১.৭৩ শতাংশ। এ গবেষণার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১২৩টি কোম্পানির কাছ থেকে করপোরেট কর এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার ৩৮৯টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভ্যাটের তথ্য সংগ্রহ করেছে সিপিডি। গবেষণায় বলা হয়, ৭২ শতাংশ কোম্পানি মনে করে, করপোরেট করের ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তাদের জন্য ‘অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ’। ৮২ শতাংশ মনে করে, তাদের ওপর ‘অন্যায্য’ হারে কর বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ৭৯ শতাংশ কোম্পানি এনবিআর কর্মকর্তাদের জবাবদিহির অভাবকে তাদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখিয়েছে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো: আবদুর রহমান বলেছেন, কর ছাড়ের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ার ফলে কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। যথেষ্ট পরিমাণ কর আদায় করতে না পারলে বিপদ আছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক জায়গায় ডিজিটাল হয়ে গেলে সহজেই কর ও ভ্যাট রিটার্ন পাওয়া যাবে।
ন্যূনতম করকে কালাকানুন উল্লেখ করে আবদুর রহমান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই ন্যূনতম কর একটা কালাকানুন। এটা স্বীকার করতেই হবে। বিজনেসে কর হবে মুনাফার ওপর। তা না করে মিনিমাম কর নির্ধারণ করছি। সমস্যা হচ্ছে; এগুলো ঠিক করতে গেলে আমাদের কর আহরণ কমে যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের অডিট রিপোর্টের কোয়ালিটি নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। অডিটের ঘোষণাগুলো দেখলে বোঝা যায় এখানে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। বর্তমানে এনবিআরে অডিটের ম্যানুয়াল সিলেকশন বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ অডিট ম্যানুয়াল সিলেকশন হলে একই ব্যক্তি প্রতি বছর অডিটের আওতায় পড়ে যায়। আমরা বলেছি অডিট সিলেকশন হবে ঝুঁকিকে ভিত্তি করে। এ কারণে আমরা যত দিন পর্যন্ত ডিজিটাল সিস্টেম করতে না পারবো, তত দিন ম্যানুয়াল ভ্যাট অডিট বন্ধ থাকবে। দরকার হলে কেয়ামত পর্যন্ত অডিট বন্ধ থাকবে। আমাদের অটোমেটেড করতেই হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমরা যে পরিমাণ ঋণ করেছি, আমাদের পরের প্রজন্মের ওপর যে পরিমাণ চাপিয়ে দিচ্ছি; যদি আমরা যথেষ্ট পরিমাণ কর আদায় করতে না পারি তা হলে বিপদ আছে।
কর জিডিপি অনুপাত ক্রমান্বয়ে কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা খুবই আশঙ্কাজনক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার দলের সাথে কথা হচ্ছিল, তারা বললেন, পাকিস্তানের কর জিডিপি অনুপাত ১২.২। আর আমাদের গত বছর ছিল ৭.৪। এ বছর আরো কমে ৬.৬ হয়ে গেছে। এটা দিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ ও দেশের উন্নয়ন করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের।
কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমরা অনেক ছাড় দিয়েছি। আমাদের অনেক বড় দেশ। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করতে হয়। আগে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বলেছি আপনারা আসেন কর দিতে হবে না। কর ছাড় এত ব্যাপক হয়েছে আমরা কোনোভাবেই কর জিডিপি অনুপাত বাড়াতে পারছি না।
কর অব্যাহতি পাওয়ার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা বারবার কর ছাড় চান জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাপারটা এরকম হয়েছে যে অনেক সময় দুই দিন ট্যাক্স দিতে হয় না; যে দিন রোদ উঠে, যে দিন মেঘলা হয়, এই দুই দিন দিতে হয় না। এই ধরনের কর অব্যাহতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এটা হলে কর জিডিপি অনুপাত বাড়বে কীভাবে?
তিনি বলেন, অবশ্যই আমাদের অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো আমাদের সমাধান করতে হবে। আমরা স্বচ্ছ ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন করার চেষ্টা করছি।
এ দিকে, গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ কর কর্মকর্তাদের জবাবদিহির অভাবকে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৭২ শতাংশ বলেছেন, কর প্রশাসনে দুর্নীতি তাদের জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর জমা দেয়ার ব্যবস্থা না থাকাও ব্যবসায়ীদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত এ সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ ব্যবসায়ী নিয়মিত কর দাবিকে কেন্দ্র করে কর কর্মকর্তাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, যথাযথ ব্যাখ্যা বা পূর্বাভাস ছাড়াই কর কর্মকর্তারা অনেক সময় ইচ্ছামতো কর আরোপ করেন। তাদের মতে, এসব অনুশীলন করের অঙ্কের বাইরে গিয়ে অদৃশ্য চাপ তৈরি করে, যা ব্যবসার জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভ্যাট হারের জটিলতাকে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেকে। অংশগ্রহণকারী ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, জটিল ভ্যাট আইন তাদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।
এ ছাড়া অস্পষ্ট ভ্যাট নীতিমালা, কর কর্মকর্তাদের সীমিত সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার ঘাটতি, পণ্য ও সেবার শ্রেণিবিন্যাসে জটিলতা এবং উচ্চ অনুবর্তন ব্যয় ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
মুক্ত আলোচনায় সাবেক অর্থসচিব সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ব্যক্তির অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। করপোরেটের ক্ষেত্রে দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। শিক্ষা ও শিক্ষার ব্যবসা আলাদা করে করের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।
আলোচনায় ট্যাক্স বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ এইচ মাহবুব সালেকিন বলেন, কর অফিসে দুর্নীতি একটু বেশি। যদি আমাদের মামলাগুলো দ্রুত ও স্বচ্ছতার সাথে সমাধান করা যেতো তা হলে রাজস্ব আহরণ বেশি হতো। তা হলে বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভর করা লাগতো না। এনবিআর চেয়ারম্যানের এ বিষয়ে আন্তরিকতা দেখা গেছে।