এম কে জাকির হোসাইন বিপ্লবী
পৃথিবীতে এমন কিছু রুহানি শক্তি আছে, যা কখনো দেখা যায় না। অনুভবে বোঝে নিতে হয়। তবে সেগুলো সৃষ্টির সূচনা কোনো ব্যক্তির দ্বারা হয়নি, সেগুলো একমাত্র আল্লাহপ্রদত্ত শক্তি। যেমন বাতাস, অনুভব করা যায় দেখা যায় না। ঠিক সেরকম পবিত্র কুরআনও একটি আলোকিত গ্রন্থ। পবিত্র কুরআন পড়া যায়; কিন্তু তার আলো কখনো দেখা যায় না। তবে সেই আলো অনুভবে বোঝা যায়। পবিত্র কুরআন হলো মানব জীবনের একমাত্র জীবনব্যবস্থা। সুন্দর জীবন ও আদর্শ জীবন গঠনে কুরআনের বিকল্প কিছু নেই। যদিও কুরআনের আলো অদৃশ্য, তবে সেই আলোর প্রভাব যার উপরে পড়ে, তার জীবন হয় অত্যন্ত সুন্দর।
কুরআনের আলোয় আলোকিত জীবন : পবিত্র কুরআন হলো আল্লাহপ্রদত্ত একটি ধর্মগ্রন্থ। আমি বিশ্বাস করি, কুরআন ব্যতীত পৃথিবীতে যত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে, সবগুলোই পাণ্ডিত্য অর্জনকারী অথবা বিখ্যাত মানুষের তৈরি। আর সেই কুরআনের নীতি অনুযায়ী, পবিত্র শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম এবং শ্রেষ্ঠ জাতি মুসলমান। তবে পবিত্র কুরআন জ্ঞানার্জনের জন্য সবাই পড়তে পারবে। মানুষের জীবনকে অমানিশার কালো আঁধার থেকে আলোকিত জীবনে রূপান্তরিত করার জন্য পবিত্র কুরআনের বিকল্প কিছু নেই। মানবজীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি দিশায় যেখানে অন্ধকার ও বিভ্রান্তি দোল খায়, সেখানে একমাত্র কুরআনের আলোই হতে পারে সঠিক পথের দিশারি। কুরআন আল্লাহপ্রদত্ত এক অপার রহমত, যা শুধু একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়; বরং এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, ন্যায়-অন্যায়, হক-বাতিলের পার্থক্যকারী মহান দলিল। যারা কুরআনের আলোয় নিজেকে আলোকিত করে, তাদের জীবন হয় পরিশুদ্ধ, হৃদয় হয় প্রশান্ত, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তি ও ইনসাফ। পবিত্র কুরআনের সঠিক জ্ঞানার্জনকারী প্রতিটি ব্যক্তিই হয় সহজ-সরল ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী। কুরআনের আলো শুধু দুনিয়া নয়, আখিরাতকেও সুন্দর করে। এ আলো মানুষকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচায়, তাওহিদের পথে দৃঢ় করে এবং পরকালের জন্য তাকে প্রস্তুত করে। যেমন আল্লাহ বলেন-‘তোমরা আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করো এবং তার আলোতে চল যা তোমাদের নাজিল করা হয়েছে।’ (সূরা আরাফ-১৫৭)
এই জীবন ক্ষণিকের; কিন্তু কুরআনের আলো চিরন্তন জীবনের সঞ্চয়। তাই সেই ব্যক্তিই ধন্য, যে নিজের জীবনকে কুরআনের ছায়ায় গড়ে তোলে, আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চলে এবং কুরআনের ভাষায় আত্মাকে জাগিয়ে তোলে।
কুরআনের রুহানি আলো : পবিত্র কুরআনের আলো মানুষের চক্ষু দিয়ে দেখা কোনো বস্তুগত আলো নয়; বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত এমন এক রুহানি আলো, যা অন্ধকার হৃদয়কে জাগ্রত করে, বিভ্রান্ত আত্মাকে হেদায়েত দেয়। আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-মায়েদার ১৫ নম্বর আয়াতে বলেন-‘হে কিতাবিগণ, তোমাদের কাছে আমার রাসূল এসেছে, কিতাব থেকে যা তোমরা গোপন করতে, তার অনেক কিছু তোমাদের কাছে সে প্রকাশ করেছে এবং অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্যই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে।’
আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, সবাইকেই সমাজকে আলোকিত করার জন্য দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন পথপ্রদর্শক, আর আল্লাহপ্রদত্ত কিতাবগুলো ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের দিকনির্দেশক। পৃথিবীতে কেবল সেই কিতাবেই সমাজ এবং দেশকে আলোকিত করতে পারে, যেই কিতাব আল্লাহ প্রদত্ত। আর সেসব কিতাবের মধ্যে সর্বশেষ কিতাব হলো আল-কুরআন। চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় আল-কুরআন নির্ভুল শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। সূরা বাকারায় ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘এটি সেই কিতাব, যার কোনো সন্দেহ নেই।’ কুরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্ট প্রমাণিত, মানুষের জীবন ও সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য কুরআনের নীতির বিকল্প কিছু নেই। কুরআন এমন এক রুহানি আলো যা দিয়ে বিশ্বকে অবলোকিত করা যায়। অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করা যায়।
এই আলো মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, নফসের জিঞ্জির ভেঙে দেয়। এটি এমন এক আলো যা অন্ধকার জীবনের সব পথ ভেদ করে ঈমান ও আমলের পথে চলার শক্তি দেয়। এ আলো চোখে দেখা না গেলেও হৃদয়ে অনুভব করা যায়, ঠিক যেমন ঈমানের গভীরতায় আমরা আল্লাহকে দেখি না; কিন্তু তাঁর উপস্থিতি উপলব্ধি করি।
আদর্শ জীবন গঠনে কুরআনের ভূমিকা : কুরআন শুধু পঠনযোগ্য নয়, তা চর্চা ও অনুসরণের মাধ্যমে একটি আদর্শ জীবনের রূপরেখা নির্ধারণ করে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- সব স্তরের জীবনব্যবস্থাকে গঠনমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক করতে কুরআন পথ দেখায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তোমাদের মধ্যে এরূপ একটি সম্প্রদায় থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং ভালো কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারাই সফলকাম।’ (সূরা আলে-ইমরান-১০৪)
আদর্শ জীবন মানে আমরা প্রথমত বুঝি, প্রতিহিংসামুক্ত জীবন। সত্যের পথে অটল থাকা, অন্যের অনিষ্ট থেকে বিরত থাকা। ভালো কাজ করা এবং অন্যকে ভালো উপদেশ দেয়া। সর্বদায় আল্লাহকে ভয় করা একজন আদর্শবান মানুষ এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেন-‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে মজবুত করে ধরো এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না।’ (সূরা আলে-ইমরান-১০৩)
আয়াতের ভাবদ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত, আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার কথা বলেছেন। সেই সাথে আল্লাহ প্রদত্ত যে নীতি-নির্দেশনা রয়েছে, সব নীতি নির্দেশনাকে জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিয়ে আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন। আমরা জানি, সমাজে শান্তি ও সুন্দর জীবন উপভোগের জন্য ঐক্যের বিকল্প কিছু নেই। একজন আদর্শ মানুষের কাজ হচ্ছে, সর্বদাই জাতিকে ঐক্যের ছায়াতলে আহ্বান করা। পবিত্র কুরআনে এ রকম অনেক আয়াত রয়েছে, যেখান থেকে আদর্শ জীবন গঠনের নির্দেশনা সহজেই গ্রহণ করা যায়। আর একজন মুমিন যদি তার জীবনকে কুরআনের আলোকে গঠন করে, তাহলে সে হবে আল্লাহভীতি-সম্পন্ন, ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু ও মানবিক চরিত্রের অধিকারী। কুরআনের নির্দেশ মানলে একজন মানুষ যেমন ভালো বাবা-মা, সন্তান, নেতা বা কর্মচারী হতে পারে, তেমনি সমাজে শান্তি ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
পবিত্র কুরআন সবার জন্য উন্মুক্ত : আমরা জানি, পবিত্র কুরআন হলো মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ। প্রশ্ন থাকতে পারে- কুরআন মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ হলে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা কি সে কুরআন পড়তে পারবে? কিভাবে কুরআন সবার জন্য উন্মুক্ত হয়?
পবিত্র কুরআনকে বিশ্লেষণ করে একজন ব্যক্তি যতটা জ্ঞানী হতে পারবে, পৃথিবীর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেই জ্ঞান কখনো অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনকে মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন। সেই কুরআনকে গবেষণা করে সমাজ পরিচালনা, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জীবনের নীতি-নির্দেশনা স্থির ক্ষেত্রে দাঁড় করানোর একটি মডেল তৈরি করে দিয়েছে। চিকিৎসা থেকে শুরু করে পৃথিবীতে এমন কোনো কর্ম বা গবেষণা নেই যা কুরআনে পাওয়া যাবে না। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে তখনই অবগত হতে পারবে, যখন সে কুরআনকে গবেষণার জন্য পড়বে। পড়াশোনা করতে গেলে কুরআনকে বুঝতে হবে, না বুঝলে কোনো কিছুই গবেষণা করতে পারবে না। আর যখন সে কুরআনকে বুঝবে, তখন সে জানতে পারবে সৃষ্টিকর্তার আসল পরিচয়।
জাগ্রত হবে ঈমানের লেলিহান দাবানল। ছুটে আসবে সত্যের পথে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানতে পাই কুরআন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অনেক বিজ্ঞানী মুসলিম হয়েছেন। যেমন আমাদের বাংলাদেশের ইসলামের অন্যতম রতœভাণ্ডার, কুরআনের পাখি শহীদ আল্লামা সাঈদী যখন কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতেন, তখন মানুষ জানতে পারত আল্লাহ তায়ালা কত মহান। আবার আল্লাহ তায়ালা কতটা কঠিন। অনেক মানুষ সেই কুরআনের পাখির হাতে মুসলিম হয়েছে। অতএব এই কুরআন সবার জন্য উন্মুক্ত। পবিত্র কুরআন সৃষ্টিকর্তাকে জানার জন্য, সৃষ্টির রহস্যকে জানার জন্য সবাই পড়তে পারবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-‘এই কুরআন মানুষদের জন্য এক স্পষ্ট বাণী, হেদায়েত ও উপদেশ।’ (সূরা আলে-ইমরান-১৩৮) আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেন-‘আমি তো তোমাদের ওপর অবতীর্ণ করেছি কিতাব, যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ, তবু কি তোমরা বুঝবে না?’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০)
অন্য আয়াতে বলেছেন- ‘অতএব তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও যে আলো (কুরআন) আমি অবতীর্ণ করেছি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করো, তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত।’ (সূরা তাগাবুন, আয়াত-৮)
লেখক : প্রবন্ধকার



