আর মাত্র দুই দিন বাকি ঈদুল আজহার। এরই মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশেই জমে উঠেছে কোরবানির পশুহাটগুলোতে ক্রয় ও বিক্রয়। পাশাপাশি মার্কেট ও গণপরিবহনে চাপ বেড়েছে। ত্যাগ ও আনন্দের এই ঈদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মৌসুমি অপরাধীরা। এক দিকে যেমন জালনোটের ছড়াছড়ি। অন্য দিকে ছিনতাই, মলমপার্টি ও অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। পশুর হাট থেকে শুরু করে ওইসব অপরাধীরা মার্কেটগুলো এবং গণপরিবহনকে টার্গেট করে সক্রিয়। যার ফলে জালনোট প্রতারণা ও অজ্ঞানপার্টি-মলমপার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন অনেকেই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, বিভিন্ন সময় আটক হওয়া জালনোটের কারবারিরা জামিনে বের হয়ে এসে আবারো এই অপরাধে জড়াচ্ছে। এরসাথে নতুন নতুন অপরাধীরা যুক্ত হচ্ছে। বাসাবাড়ির মধ্যে ছোট ছোট প্রিন্টার ও কম্পিউটার নিয়ে জালনোট তৈরি করে এসব কাজ করছে তারা। দ্রুত ও নিখুঁত জালনোট তৈরি করতে এই চক্রের সদস্যরা বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করছে। তারা এখন ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ২০০ ও ৫০ টাকার নোটও জাল করছে। তারা এতটাই দক্ষ যে তাদের জাল করা নোট হুবহু আসল টাকার মতো দেখতে। যে কেউ হঠাৎ করে হাতে নিয়ে চিনতে পারবে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। শুধু তাই নয়, চক্রটি অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই জালনোট পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের মূল মৌসুম হচ্ছে এই কোরবানির ঈদের পশুর হাট ও বড় বড় বিপণিবিতানগুলো। আর এসব কারবারিদের সাথে কিছু আইনজীবীও জড়িত রয়েছে। যারা মোটা টাকার বিনিময়ে তাদেরকে সহজেই জামিন পাইয়ে দেয়ার কাজ করছেন। তাই এদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়লেও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পল্টন থানাধীন গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনে অভিযান চালিয়ে ১ লাখ টাকার জালনোটসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা হলো- মো: সাগর (৩০), আল আমিন হাওলাদার (২৮) ও বাবু মাতব্বর (৫৪)।
ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গ্রেফতারকৃতরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের জালনোট রাজধানীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় করে আসছিল। তারা আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বিপুল জালনোট বিক্রয় করার পরিকল্পনা করছিল। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলেও জানানো হয়।
এর আগে গত ১৬ মে রাতে ওয়ারীর একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে দেশী-বিদেশী জালনোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামসহ মো: সাইদুর রহমান (৩২) ও মো: মেহেদী হাসান (২৫) নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে ডিবি। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬০০ টাকার জালনোট (১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট), ৭৭ হাজার ১০০ ভারতীয় রুপির জালনোটসহ একটি সিপিইউ ও মনিটর, প্রিন্টারের ৮টি কালির কৌটা, ১০০ পিস ফয়েল পেপার (সিকিউরিটি ফিতা) জব্দ করা হয়। গেফতারকালে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তারা বিপুল পরিমাণ জালনোট তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মজুদ রেখেছিল।
শুধু জালনোটের কারবারিরাই নয়, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে- ছিনতাইকারী-ডাকাতি চক্র, চাঁদাবাজ, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, টানা পার্টি, অপহরণকারী চক্র, মাদক ব্যবসায়ীসহ মৌসুমি অপরাধীরা। বিশেষ করে গণপরিবহন, মার্কেট-শপিংমল, ব্যাংকপাড়া, নির্জন স্থান, ব্যস্ত সড়ক ও পশুর হাটকে কেন্দ্র করে বেশি তৎপরতা বাড়িয়েছে বিভিন্ন অপরাধী চক্রকে। সুযোগ পেলেই ছোঁ মেরে লুটে নিচ্ছেন মূল্যবান জিনিস, আবার ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে লুটে নেয়া হচ্ছে সর্বস্ব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানির ঈদে গরু কিনতে মানুষ একসাথে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যবহার করেন- আবার বেপারীদের কাছেও গরু বিক্রির মোটা অঙ্কের টাকা থাকে। এজন্য ছিনতাইকারী চক্র ব্যাংকপাড়া ও পশুর হাটকে টার্গেট করছে। আবার ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটায় মার্কেট ও শপিংমলেও উপচেপড়া ভিড় থাকে। সুযোগ বুঝে টার্গেট ব্যক্তির মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঈদকে সামনে রেখে মৌসুমি অপরাধীদের অপতৎপরতা রুখতে বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে শপিংমল-ব্যাংক-মার্কেট-পশুর হাটে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। অপরাধের হটস্পটগুলোতে বাড়ানো হয়েছে পেট্রোলিং। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে চার শতাধিক ছিনতাই স্পটে সক্রিয় ছিনতাইকারী চক্রের তালিকা করে গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সেই সাথে জামিনে মুক্ত থাকা অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, টানা পার্টির সদস্যরাও রয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে।
ঈদকেন্দ্রিক সবসময় মৌসুমি অপরাধীরা তৎপর হয়ে ওঠে উল্লেখ করে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) এস এন মো: নজরুল ইসলাম বলেন, সববিষয় মাথায় রেখে আগে থেকেই ডিএমপি বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। শপিংমল-ব্যাংক-মার্কেট-পশুর হাটে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের পাশাপাশি পেট্রোল বাড়ানো হয়েছে। চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতি প্রতিরোধেও পুলিশি নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়াও ঈদের আগে জাল টাকার কারবারিরা তৎপরতা বাড়িয়ে থাকে। জাল টাকা প্রতিরোধেও ডিবি পুলিশসহ থানা পুলিশ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। আশা করছি- পুলিশের তৎপরতা ও চলমান অভিযানের কারণে মৌসুমি অপরাধীরা অপরাধ করতে গেলেই আইনের আওতায় আসবে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে পশুর হাট, কোরবানি, ঈদের জামায়াত, চামড়া বেচাকেনাসহ বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অপতৎপরতা রুখতে সচেষ্ট রয়েছে র্যাব।