কাঁচামাল সঙ্কটে দেশের পাট শিল্প

রফতানি সীমিত হলেও মিলগুলোতে সঙ্কট কাটছে না

মিলগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ার পর সরকার গত মাসের শেষের দিকে কাঁচা পাট রফতানিতে সীমা নির্ধারণ করে দেয়।

শাহ আলম নূর
Printed Edition

সরকার কাঁচা পাট রফতানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করলেও স্থানীয় বাজারে পাট কার্যত উধাও। এমন পরিস্থিতিতে মিলগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ার পর সরকার গত মাসের শেষের দিকে কাঁচা পাট রফতানিতে সীমা নির্ধারণ করে দেয়।

পাট অধিদফতরের (ডিওজে) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কৃষকরা প্রতি মণ পাট তিন হাজার ৪০০ থেকে তিন হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এখন প্রতি মণ পাটের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩০০ থেকে চার হাজার ৫০০ টাকা। এই হঠাৎ দাম বৃদ্ধি ও বাজারে ঘাটতি পাটকল মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। অনেকেই বলছেন, বছরের পর বছরেও এমন কঠিন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। মৌসুমের মধ্যেই কাঁচামাল যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) ও বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) গত সপ্তাহে জরুরি বৈঠক করে কাঁচা পাটের সঙ্কট, বাজার অস্থিরতা ও সরবরাহ ঘাটতি মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করেছে। বিজেএসএর চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘বাজারে এখন অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। অনেকে কাঁচা পাট মজুদ করছে, ফলে প্রকৃত মিল মালিকরা উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পাট পাচ্ছেন না। এতে গোটা পাটশিল্প গভীর সঙ্কটে পড়েছে।’

বিজেএসএর সাবেক চেয়ারম্যান মো: জাহিদ মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে দাম ২০২১ সালের রেকর্ড ছয় হাজার ২০০ টাকাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখনই দেশ প্রায় ৩০ শতাংশ বাজার হারিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, ‘সেই সময়ে পলিপ্রোপিলিন সুতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ ক্রেতারা ব্যয়বহুল পাটজাত পণ্যের পরিবর্তে সস্তা বিকল্পে ঝুঁকেছিল। এখন কারপেটে পুনর্জাত তুলার ব্যবহারও বাড়ছে, কারণ তুলার কারপেট ভাঁজ করা সহজ। একজন মিল মালিক জানান, অনেকে এখন পরিবারের সদস্যদের নামে আলাদা লাইসেন্স নিচ্ছে শুধু পাট মজুদের জন্য, এটা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, পাট আইন ১৭ ধারায় বলা আছে, এক মাসে কেউ এক হাজার মণের বেশি পাট মজুদ রাখতে পারবেন না। অথচ গত দুই মাসে লাখ লাখ মণ পাট মজুদ হয়েছে। আইন কার্যকর হচ্ছে না।

এ দিকে বিজেএমএর চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, পাট খাত টিকিয়ে রাখতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো আধুনিক ডেটা সেন্টার ও পৃথক ‘জুট কমিশন’ গঠন করা দরকার। তিনি আরও বলেন, অন্য ফসলের মতো কাঁচা পাটেরও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা দরকার, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান ও উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে মিলগুলো টিকে থাকতে পারে। তা না হলে রফতানি বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

বিজেএসএর চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক সতর্ক করে বলেন, যদি মিলগুলো কাঁচামাল না পায়, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হবে, উৎপাদন বন্ধ হবে এবং দেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস হারাবে। বিজেএসএ ও বিজেএমএ উভয় সংগঠনই অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত কাঁচা পাট রফতানিতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি জানিয়েছে। অন্য দিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি মার্কিন ডলার। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ১১৩ কোটি ডলারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি আয় হয় ৯১১.৫১ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩-২৪ সালে ৮৫৫.২৩ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৮২০.১৬ মিলিয়ন ডলারে।