তিস্তা সেচ প্রকল্প সম্প্রসারণ
- পৌনে ৪ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ৫২.১০ শতাংশ
- সিল্ট ট্র্যাপ খনন না হওয়ায় ভরাট হয়েছে
- নির্মাণে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ ও অনেক বড় প্রকল্পই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই গ্রহণ ও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর এসব প্রকল্পেই দফায় দফায় খরচ ও ব্যয় বাড়ছে। বছরের পর বছর চলছে, শেষ হচ্ছে না। ঠিক তেমনি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকা পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পটিও চলছে কচ্ছপগতিতে। সাড়ে তিন বছরের প্রকল্পটি পৌনে চার বছরে অগ্রগতি মাত্র ৫২.১০ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে আরো হয়তো চার বছর লাগবে বলে পরিকল্পনা কমিশনের আশঙ্কা। পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান পাড়া বলছে, সিল্ট ট্র্যাপ খননকাজ না হওয়ার কারণে সেটি ভরাট হয়ে গেছে, যা প্রকল্পের অন্যান্য সেচখাল পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণ কাজে সমস্যা সৃষ্টি করছে। সরেজমিন স্পট পর্যবেক্ষণ ফলাফলে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পাদনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যত্যয় পাওয়া গিয়েছে। যেমন- নির্মাণকাজের কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পেসিফিকেশন পরিমাপে প্রাক্কলনের চেয়ে প্রকৃত পরিমাণ কম-বেশি পাওয়া গিয়েছে (প্যাকেজ নং- ডালিয়া/পরিদর্শন রাস্তা-০৫, প্যাকেজ নং- সৈয়দপুর/সেতু-০২, অনুঃ ৩.২.৫.২, পৃঃ ৪৬ ও ৪৮-৪৯)।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প দলিলের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর থেকে সেচখালসমূহের নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করে। আর সে কারণে তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় সেচের আওতাভুক্ত এলাকা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি কম থাকলেও সেচভুক্ত এলাকা বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেচখালসমূহের পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণ কাজ সম্পাদন করে নিরবচ্ছিন্নভাবে সেচের পানি সরবরাহ করে প্রকল্পের সেচযোগ্য এলাকা বৃদ্ধি ও ফসলের নিবিড়তাসহ উৎপাদন বৃদ্ধি করার একান্ত প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় নীলফামারী জেলার ডালিয়া পয়েন্টে বিগত ২৩ বছরের শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে প্রাপ্ত পানি প্রবাহ (বাপাউবোর হাইড্রোলজি ইউনিট থেকে প্রাপ্ত) বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১২ সাল হতে নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেলেও তখন থেকে অদ্যাবধি শুষ্ক মৌসুমে প্রাপ্ত পানি সম্পূর্ণরূপে সেচখালসমূহে সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে সেচখালসমূহের নাজুক অবস্থায় থাকা। সেচখালসমূহের বিদ্যমান নাজুক অবস্থা তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যে সেচ প্রদানে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এ সমস্যা নিরসনের জন্য সেচখালসমূহের পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণ কাজ সম্পাদন করা সমীচীন। সেচখালসমূহের পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণ কাজ সম্পাদন অত্র অঞ্চলে সেচযোগ্য এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন ও নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণে সহায়ক হবে। তাই প্রকল্পটি নেয়া হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক চলমান প্রকল্প গ্রহণ করে। বাপাউবো কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট এক হাজার ৪৫২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় জুলাই ২০২১ হতে ডিসেম্বর ২০২৪ মেয়াদে সাড়ে ৩ বছরে বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের ৪ মে একনেক থেকে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদকাল দুই (২) বছর বাড়িয়ে জুলাই ২০২১ হতে ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের মেয়াদকাল ৪৪ মাস থেকে ৬৬ মাসে উন্নিত হয়েছে।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যগুলো হলো
প্রকল্পের ১.০৪ লাখ হেক্টর জমিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সেচের পানি সরবরাহ করার মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা ২৩১ থেকে ২৬৮ শতাংশ এ উন্নীত করা। প্রতি বছরে অতিরিক্ত প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন এবং ৫.২৭ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকরণ (প্রায় ৮৬ লাখ জন-দিন)। প্রকল্প এলাকায় পরিবেশ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নীতকরণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত ৩০ লক্ষাধিক মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি করা।
পৌনে ৪ বছরে অগ্রগতি ৫২.১০ শতাংশ
হালনাগাদ তথ্য বলছে, প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি গত তিন বছর ৯ মাসে অর্থাৎ মার্চ, ২০২৫ পর্যন্ত ৪১.৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়ন হয়েছে ৫২.১০ শতাংশ। এখানে মূল অঙ্গগুলোর মধ্যে সেচখালের ডাইক পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণ, সে্লাপ প্রোটেকশন ও মেরামত কাজে বাস্তব অগ্রগতি ৫১.৫৭ শতাংশ, সাইফুন, এস্কেপ ও রেগুলেটর নির্মাণ ও মেরামত কাজ ১৫.০৩ শতাংশ, বাইপাস সেচখাল, রেগুলেটর মেরামত, ভূগর্ভস্থ সেচ পাইপ স্থাপন ও ক্যানেল ক্রসিং স্লাব নির্মাণকাজের বাস্তবায়ন ১৫.৬২ শতাংশ, সেতু নির্মাণ কাজ ৯২.৮৪ শতাংশ, কালভার্ট নির্মাণ ৭৪.৯২ শতাংশ, রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ৯০.৪৯ শতাংশ, বনায়ন কাজে ৯১.০৩ শতাংশ অর্জন হয়েছে।
আইএমইডির নিয়োগপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ অব হিউম্যান ফর এডভান্সমেন্ট (পাড়া) প্রকল্পটি সম্পর্কে বলছে, তিস্তায় পানি কম রয়েছে। তাই প্রকল্পের মাধ্যমে পূর্বের ৮৪ হাজার হেক্টর এরিয়ায় বিদ্যমান অবকাঠামো পুনর্বাসনসহ আরো নতুন ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের কার্যক্রম কতটা বাস্তবসম্মত হবে সে বিষয়ে মাঠ বাস্তবতার আলোকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পানি যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো সিল্ট ট্র্যাপ। যা বর্তমানে ভরাট হয়ে আছে। এটির খননকাজ চালু রাখার জন্য একাধিক ড্রেজার কেনা দরকার।
প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও দখল উদ্ধারকরণ কাজে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। চলমান ভূমি অধিগ্রহণ ও দখল উদ্ধারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।