চিকেনস নেক ঘিরে ভারতের উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক

আঞ্চলিক উত্তেজনা ও দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতির নতুন বার্তা

এই বৈঠকের পেছনে একটি বড় অপ্রকাশ্য প্রেক্ষাপট রয়েছে- বাংলাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বিষয়ক ঘোষণা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের উত্তাপ এবং সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা। এসব বিষয় ভারতের দৃষ্টিতে চিকেনস নেক অঞ্চলের নিরাপত্তাকে আরো স্পর্শকাতর করে তুলেছে।

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
  • বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলে নিয়ে ভারত চিকেন নেককে গণ্ডারের ঘাড়ে পরিণত করতে চায় : ড. শাহীদুজ্জামান

  • বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবেই ভারত এসব করছে ব্রিগেডিয়ার (অব:) রোকন উদ্দিন

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত কৌশলগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেনস নেক’ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃবাহিনী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় স্টেট সাবসিডিয়ারি মাল্টি এজেন্সি সেন্টারের (এসএমএসি-এর রাজ্য শাখা) ব্যানারে, যেখানে ভারতের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- ভারতীয় সেনাবাহিনী, আর্মি ইন্টেলিজেন্স, ভারতীয় বিমানবাহিনী (আইএএফ), বিএসএফ, এসএসবি, সিআইএসএফ, আইটিবিপি, আরপিএফ, জিআরপি, রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য স্তরের একাধিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল- চিকেনস নেক অঞ্চলের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, সীমান্ত নজরদারি, অবৈধ অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ এবং আন্তঃসংস্থাগত গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা।

দিল্লির বিস্ফোরণ ও আঞ্চলিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বৈঠকের তাৎপর্য : ভারতের সংবাদমাধ্যম ইটিভি ভারতের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিল্লির লাল কেল্লার নিকটে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনার পর উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই করিডোর অঞ্চল নতুন করে নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণে চলে এসেছে। পাশাপাশি, প্রতিবেশী দেশগুলো- বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতার আবহ, এবং ভুটান-চীন সীমান্ত পরিস্থিতির সংশ্লিষ্টতা এই বৈঠককে নতুন গুরুত্ব দিয়েছে।

যদিও শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার সি সুধাকর এই বৈঠককে ‘রুটিন’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত বৈঠকের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলা সম্ভব নয়- এটি আমাদের নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ।’ তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এই বৈঠক প্রতীকীভাবে রুটিনের চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

রেল, সড়ক ও বিমান নিরাপত্তায় বিশেষ সতর্কতা : বৈঠক শেষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে : বাগডোগরা বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে যাত্রী তথ্য যাচাই ও আচরণগত স্ক্রিনিং শুরু করা হয়েছে; এনজেপি, শিলিগুড়ি জংশন, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার স্টেশনে বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে; রাজধানী এক্সপ্রেস ও বন্দে ভারতসহ গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলোতে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে এবং জাতীয় মহাসড়ক ও এশিয়ান হাইওয়েতে অতিরিক্ত পুলিশ টহল শুরু করা হয়েছে।

বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি : ভারত সরকার একইসাথে তিনটি সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ভারত-নেপাল সীমান্ত, ভারত-ভুটান সীমান্ত ও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। বিশেষভাবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে স্বয়ংক্রিয় নম্বর প্লেট রিডার (এএনপিআর) মেশিন স্থাপন কার্যক্রম দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে, যা সীমান্ত দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের তথ্য রিয়েল টাইমে সংগ্রহে সহায়তা করবে।

রাফাল বিমান ও আধুনিক যুদ্ধসজ্জার বার্তা : বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চিকেনস নেক-সংলগ্ন বিমান ঘাঁটিতে রাফাল যুদ্ধবিমানসহ অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ও নজরদারি ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এটা শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং একটি স্পষ্ট ভূরাজনৈতিক প্রতীকী বার্তা-বিশেষ করে চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি।

চিকেনস নেক কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ : চিকেনস নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর মাত্র ২২ কিলোমিটার চওড়া একটি ভূখণ্ড, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করে। এই সঙ্কীর্ণ করিডোরের চারপাশে রয়েছে- পশ্চিমে নেপাল, দক্ষিণে বাংলাদেশ এবং উত্তরে ভুটান ও চীন সীমান্ত। ফলে, এই একটি করিডোরের নিয়ন্ত্রণ বা নিরাপত্তা ভারতের জাতীয় সংহতি ও সামরিক নিরাপত্তার জন্য জীবনরক্ষাকারী ধমনীস্বরূপ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভারতীয় উদ্বেগ : বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৈঠকের পেছনে একটি বড় অপ্রকাশ্য প্রেক্ষাপট রয়েছে- বাংলাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতা বিরোধি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বিষয়ক ঘোষণা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের উত্তাপ এবং সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা। এসব বিষয় ভারতের দৃষ্টিতে চিকেনস নেক অঞ্চলের নিরাপত্তাকে আরো স্পর্শকাতর করে তুলেছে।

নিছক রুটিন, নাকি কৌশলগত প্রস্তুতি : সরকারি ভাষ্যে এটি ‘রুটিন বৈঠক’ হলেও বাস্তবতা ভিন্ন বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন নিরাপত্তা ভারসাম্যের প্রস্তুতি, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে ভারতের কৌশলগত বার্তা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভবিষ্যৎ সামরিক প্রস্তুতির রূপরেখা হতে পারে।

ভূরাজনীতিবিদদের মতে- চিকেনস নেক এখন কেবল একটি ভূগোল নয়- এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ শক্তি-সমীকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

ভারত চিকেন নেককে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলে নিয়ে গণ্ডারের ঘাড়ে পরিণত করতে চায় : ড. শাহীদুজ্জামান

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, এটা স্পষ্ট যে চিকেনস নেক এখন আঞ্চলিক উত্তেজনা ও দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিতে নতুন বার্তা দিতে শুরু করেছে। লালমনিরহাটে বাংলাদেশে যে বিমানঘাঁটি উন্নয়ন করছে, মিলিটারি কনস্ট্রাকশন হচ্ছে, হ্যাঙ্গার তৈরি হচ্ছে, চীন কিংবা পাকিস্তান থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের পর সেখানে মোতায়েনের কথা শোনা যাচ্ছে, নিশ্চিতভাবে বলা যায় লালমনিরহাট এখন বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছে। চীন সেখানে ইনভলভড হবে কিন্তু এটা ভারত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, যেটাকে ওরা চিকেন নেক বলে যা ২২ কিলোমিটার চওড়া সেটাকে তারা গণ্ডারের ঘাড় বা রাইনো নেকে পরিণত করতে চায়। ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের রংপুরের ভূখণ্ডের বেশ কিছুটা ভেতরে ঢুকে যেতে চাচ্ছে। চিকেন নেকের ২২ কিলোমিটার অংশকে তারা কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটারে বর্ধিত করতে চায়। সেখানে যে ভারত কৌশলগতভাবে তিনটি গ্যারিসন স্থাপন করেছে, সেনা মোতায়েন করেছে এসব পরিকল্পনা মাথায় রেখেই। তারা সমর বিন্যাস এমনভাবে করছে, সেনা মোতায়েন এমনভাবে করছে যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যেন চিকেন নেক দখলে নিয়ে নিতে পারে। চীনভীতি ও বাংলাদেশের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়াতেই ভারত এসব করছে।

এম শাহীদুজ্জামান বলেন, ভারতের আভাস থেকে সুস্পষ্ট যে চিকেন নেক দখল বা সেখানকার পরিধি বাড়াতে তারা বাংলাদেশের ভূমি প্রয়োজনে দখলে নেবে। এ কারণেই তিনটি গ্যারিসনে সেনা মোতায়েন করছে তারা। ভারত যদি চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনসহ অন্যান্য আইন ভাঙতে চায় তাহলে তারা সেটাই করবে। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের ওপর ভারত চাপ সৃষ্টি করছে বলে আমরা মনে করছি। কিন্তু ভারত যদি তা করতে চায় তাহলে বাংলাদেশে আঘাত করেই চিকেন নেকের সম্প্রসারণ ঘটাবে। ভারত বাংলাদেশের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর উন্নয়নকাজ বন্ধ করার জন্যই।

চীনভীতি থেকে এই তৎপরতা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) রোকন উদ্দিন বলেন, ভারত চিকেন নেকের আশেপাশে যে তিনটি সেনাঘাঁটি করেছে বা সম্প্রতি বিষয়টি একাধিক নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করছে, মূলত দেশটি এসব করছে চীনভীতি থেকে। চীন যেকোনো সময় চিকেন নেকের আশেপাশে এলাকা দখল করে নিতে পারে এমন ভীতি কাজ করছে ভারতের মধ্যে। এ কারণেই চিকেন নেক ঘিরে তাদের সামরিক ও বেসামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপের অংশ হিসেবেও ভারত এ ধরনের আচরণ করছে। যেমন- লালমনিরহাটের উল্টা পাশে ভারত রাফায়েল বিমান ও সেনা মোতায়েন করেছে। ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে।

তিনি বলেন, চীনের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব শক্তিশালী হচ্ছে এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ছে। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে। তিব্বত সীমান্তে ভারতের সাথে চীনের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত পুশইন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ভারত উসকানি দেয়ায় তারা ফের তৎপর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবেই ভারত এসব করছে। বিশেষ করে কেএনএফকে ভারত টোপ দিয়ে ও দীর্ঘদিন থেকে সন্তু লারমার সমর্থিত গোষ্ঠীকে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য ব্যবহার করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়ে ভারতের এ ধরনের অপতৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে যেকোনো সরকারই আসুক ভারত সে সরকারকে চাপে রাখতে চায় বলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি প্রেশার পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে।