- অগ্রগতি ২২.৪৬ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে
- ভর্তি হয়েও ঝরে পড়েছে ৪ হাজার ৩০২ জন
গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প দুর্বল সমীক্ষার কারণে নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হচ্ছে না। আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের অর্থ ছাড় ও প্রয়োজনীয় মালামাল কেনাকাটা না করার কারণেও প্রকল্প পিছিয়ে পড়ছে। বিদেশের জন্য দক্ষ গাড়িচালক তৈরির এমনই একটি প্রকল্পে নেই বিদেশী ভাষা শেখানোর কোনো প্রশিক্ষক। মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ভোলা, নরসিংদী, রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রামে কোনো ভাষা প্রশিক্ষক নেই। অন্য দিকে শিক্ষা নেয়ার পর প্র্যাকটিস করার মতো প্রশিক্ষণযানের সঙ্কট রয়েছে। যার কারণে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের বেশি প্র্যাকটিস করতে পারছে না। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অগ্রগতি ২২.৪৬ শতাংশ পিছিয়ে আছে। ভর্তির পর চার হাজার ৩০২ জন ঝরে পড়েছে। করোনার কারণে প্রকল্পের প্রশিক্ষণ কাজ শুরু করতে ২১ মাস বিলম্ব হয় বলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আইএমইডি থেকে জানা গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের তথ্য থেকে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা বেগবান করার পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ জনশক্তিকে সত্যিকারভাবে মানবসম্পদে রূপান্তর করা। এজন্য প্রয়োজন দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। শিল্পসহায়ক দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করাই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। দেশে-বিদেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অদক্ষ কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ শতাংশ। এত অধিক সংখ্যক অদক্ষ কর্মীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ কর্মীতে রূপান্তর করে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাবে।
এ দিকে, সড়ক দুর্ঘটনার হার দিন দিন বাড়তে থাকায় দেশ-বিদেশে দক্ষ গাড়িচালকের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সৌদি আরবের বাসাবাড়িতে প্রায় এক লাখ ড্রাইভারের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে মর্মে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস হতে জানানো হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে এবং দেশ-বিদেশে বিশেষ করে সৌদি আরবে ড্রাইভিং পেশায় কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে অর্জনের জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীন ৬৪টি টিটিসির প্রতিটিতে দু’টি প্রশিক্ষণ গাড়ির মাধ্যমে (প্রতি গাড়িতে ২০ জন করে, সকাল শিফটে দুই ব্যাচ ও বিকাল শিফটে ২ ব্যাচ) ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ‘দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাঁচ বছরের এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৬৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এখন মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ বছরে এক লাখ দুই হাজার চার শ’ জনকে ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। এসব ড্রাইভারদেরকে টেস্টিং ও লাইসেন্স প্রদানের জন্য সৌদি আরবস্থ দাল্লাহ আল বাকারা এর সাথে আলোচনা হয়েছে। দাল্লাহ আল বাকারা বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষিত ড্রাইভারদের পরীক্ষা গ্রহণ ও লাইসেন্স প্রদান করবে। সৌদি আরবে ওই কোম্পানি ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও প্রধান কার্যক্রম : দেশ-বিদেশে বিশেষ করে সৌদি আরবে ড্রাইভিং পেশায় কর্মসংস্থান। দেশ-বিদেশে পেশাদার ড্রাইভারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১০৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা। যার মাধ্যমে এক লাখ দুই হাজার চার শ’ জন দক্ষ ড্রাইভার তৈরি করা। প্রকল্পের প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে ১৩৬টি মোটরযান ক্রয়, এক লাখ দুই হাজার চার শ’জনকে প্রশিক্ষণ, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি (সিমুলেটর) ক্রয় ইত্যাদি।
সোয়া ৫ বছরে অগ্রগতি ৪৯.২১ শতাংশ : প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। মূল কার্যক্রমের মধ্যে ১৩৬টি মোটরযান ক্রয়। এর মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১১৩টি যানবাহন কেনা হয়েছে। বাকি ২৩টি যানবাহন এখনো ক্রয় করার অনুমোদন অর্থ মন্ত্রণালয় দেয়নি। ওই যানবাহনগুলো আরো ৪০টি সিমুলেটরসহ আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুন ভাবে নির্মিত ৪০টি টিটিসিতে শিগগিরই ক্রয় করে দেয়া হবে। প্রকল্পটির জুন ২০২৪ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ছিল ৪৪.৩৪ শতাংশ এবং ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৯.২১ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৩১ কোটি ৫৭ লাখ ৩৮ হাজার পাঁচ শ’ টাকা।
প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ দুই হাজার চার শ’ জন প্রশিক্ষণার্থীকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩টি ব্যাচে মোট ৫০ হাজার ৫৯১ জন প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬ হাজার ৫৫৭ জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তিন হাজার ৬৩৭ জন প্রশিক্ষণার্থী ড্রপ আউট হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে মোট দুই হাজার ২৭১ জন প্রশিক্ষণার্থী মহিলা ছিলেন। এ ছাড়াও ২৪৭ জন প্রশিক্ষণার্থী ভারী লাইসেন্স প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়েছে। যাদের ১৪৫ জন কোর্স সম্পন্ন করেছে। ১৩৬ জন বিআরটিএ কর্তৃক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। কোর্স সম্পন্নকৃত প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৬১১ জন লাইসেন্স পেয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার শতকরা হার ৮৩.২৯ শতাংশ। যেসব প্রশিক্ষণার্থী ইতোমধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৪৪০ জন প্রশিক্ষণার্থী দেশে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত আছে। ১২ হাজার ২৩ জন প্রশিক্ষণার্থী বিদেশে গিয়ে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়েছে।
আর প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী ১১টি পণ্য ও একটি সেবা প্যাকেজসহ মোট ১২টি প্যাকেজ রয়েছে, প্যাকেজগুলো হলো, প্রশিক্ষণ গাড়ি/যানবাহন ক্রয়, প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতি ও অফিস সরঞ্জামাদি। ইতোমধ্যে প্রায় প্যাকেজগুলোর ক্রয় সম্পন্ন হয়েছে। ক্রয়কার্যক্রমে কোনো ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সারা দেশের ৬৪টি টিটিসি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ২৬৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকার প্রকল্পটি পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি।
প্রকল্পের দুর্বলতা : দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে- লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পিছিয়ে থাকা। ডিপিপি বা আরডিপিপি অনুযায়ী যথাযথভাবে অর্থ ছাড় না হওয়া। বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ভাষা শিক্ষা প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে না হওয়া। প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য গাড়ি অনুশীলন সময় কম হওয়া। দাল্লাহ আল বাকার কর্তৃক সব টিটিসিতে টেস্টিং পরীক্ষা না নেয়া। যেসব টিটিসিতে দুই ব্যাচে প্রশিক্ষণ চলমান, সেখানে প্রশিক্ষণার্থীর তুলনায় অনুশীলন গাড়ি অপ্রতুল। ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন।
রাউডোর সরজমিনের তথ্য বলছে, প্রতিটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নিজস্ব মাঠ না থাকায় অন্য মাঠে গিয়ে অনুশীলন করতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন গড়ে ৫-৭ মিনিট গাড়ি চালানো শিখানো প্র্যাকটিস/অনুশীলন করতে পারেন, যা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে শুধুমাত্র ম্যানুয়াল গিয়ার ব্যবহার করে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব কর্মজীবনে গাড়ি চালাতে হলে দুই ধরনের গিয়ার ব্যবহার করে গাড়ি চালানো শিখানো প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোতে বিদেশী ভাষা বা আরবি ভাষা সম্পর্কে কোনো প্রশিক্ষণ বা ক্লাস নেয়া হয় না। কেন্দ্রগুলোতে কোনো ভাষা প্রশিক্ষক নেই। প্রকল্পের আওতায় যেসব প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণকার্যক্রম প্রদান করা হবে, এসব ড্রাইভারদেরকে টেস্টিং ও লাইসেন্স প্রদানের জন্য সৌদি আরবস্থ দাল্লাহ আল বাকারার সাথে আলোচনা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষিত ড্রাইভারদের পরীক্ষা গ্রহণ ও লাইসেন্স প্রদান করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ঢাকায় মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে দাল্লাহ আল বাকার কর্তৃক সাতজনকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে।
আইএমইডির নিয়োগপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক রুরাল অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (রাইডো) প্রকল্পটি সম্পর্কে বলছে, সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আগের ৬৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দু’টি শিফটে এবং নতুন নির্মিত ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি শিফটে প্রশিক্ষণকার্যক্রম চালু করা উচিত। প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রকল্পের অবশিষ্ট সময়ে সময়মাফিক অর্থছাড়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। প্রশিক্ষণার্থীদের বিদেশে গাড়ি চালনার সুবিধার্থে বাম হুইলযুক্ত প্রশিক্ষণ গাড়ির মাধ্যমে অনুশীলনের ব্যবস্থা করা। বিদেশী ভাষা বিশেষ করে আরবি ও ইংরেজি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করা, যা প্রকল্পে নেই। প্রকল্পের অবশিষ্ট সময়ে প্রতিটি টিটিসিতে যাতে দাল্লাহ আল বাকারা অথবা অনুরূপ কোনো নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক টেস্টিং ও লাইসেন্স প্রদান করা হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাহলে বাংলাদেশ দক্ষ ড্রাইভার বিদেশে পাঠিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থান ও প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করতে পারবে।