দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ২০১৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের পর এবারের নির্বাচনী হাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্যাম্পাসে এখন একটাই সুর- এবারের ডাকসু হবে কোনো দলের নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও নতুন বাস্তবতা : ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনই ঘটায়নি, দেশের শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশও পাল্টে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা দলীয় আধিপত্য ও ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে এখন প্রশাসনই ক্যাম্পাসের মূল নিয়ন্ত্রক। ফলে আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে নতুন ছাত্র রাজনীতির ‘শুদ্ধি পরীক্ষা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অতীত থেকে শিক্ষা : ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যেমন উৎসাহ ছিল, তেমনই হতাশাও তৈরি হয়। ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে শিক্ষার্থীরা আস্থা হারায়। যদিও স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল হক নুর ভিপি হয়ে আশার আলো দেখান, পূর্ণাঙ্গ ডাকসু কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেই অভিজ্ঞতাই শিক্ষার্থীদের এবার একটি স্বচ্ছ ও কার্যকর নির্বাচনের দাবি তুলতে সাহায্য করেছে।
এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা : ২০২৫ সালের নির্বাচনে লড়াই হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লড়াকু মুখ বনাম প্রচলিত ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে। স্বতন্ত্র ও দলীয় উভয় প্যানেল থেকেই পরীক্ষিত নেতারা আসায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ জমে উঠবে। চায়ের দোকান থেকে সেমিনার লাইব্রেরি- সব জায়গাতেই আলোচনার কেন্দ্র এখন একটাই প্রশ্ন: একটি সত্যিকারের কার্যকর ছাত্র সংসদ গঠন করা সম্ভব হবে কি না।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা : সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমরা এমন ডাকসু চাই, যারা সিট বাণিজ্য বা গেস্টরুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। প্রার্থী যেই হোক, তার শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করার সদিচ্ছা থাকতে হবে।’
শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের রামিসা রহমান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচিত হলে তাদের প্রথম কাজ হবে হলগুলোতে সুষ্ঠু আবাসন নিশ্চিত করা। খাবার, পরিবেশ, নিরাপত্তা- সব কিছুতে নজর দিতে হবে।’
ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল : ভিপি আবিদ, জিএস তানভীর
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সংবাদ সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে ছাত্রদল। ভিপি: আবিদুল ইসলাম খান (ইসলামিক স্টাডিজ); জিএস: শেখ তানভীর বারী হামিম (উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ); এজিএস: তানভীর আল হাদী মায়েদ (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা)।
অন্যান্য পদে যেসব প্রার্থীরা : মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক: আরিফুল ইসলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক : এহসানুল ইসলাম, কমনরুম, পাঠকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক : চেমন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা, আন্তর্জাতিক: মো: মেহেদী হাসান সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক : আবু হায়াত মো: জুলফিকার জিসান, ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক : চিম চিম্যা চাকমা, ছাত্র পরিবহন বিষয়ক সম্পাদক : মো: সাইফ উল্লাহ (সাইফ), সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক, সৈয়দ ইমাম হাসান অনিক, ক্যারিয়ার উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক, মো: আরকানুল ইসলাম রূপক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক : আনোয়ার হোসাইন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক : মো: মেহেদী হাসান মুন্না।
সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন : মো: জারিফ রহমান, মাহমুদুল হাসান, নাহিদ হাসান, মো: হাসিবুর রহমান সাকিব, মো: শামীম রানা, ইয়াসিন আরাফাত আলিফ, মুনইম হাসান অরূপ, রঞ্জন রায়, সোয়াইব ইসলাম ওমি, মেহেরুন্নেসা কেয়া, ইবনু আহমেদ, সামসুল হক আনান ও নিত্যানন্দ পাল।
গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদটি জুলাই হামলায় আহত মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা আহমেদের সম্মানে খালি রাখা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল : লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন করে প্যানেল ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ। এ প্যানেলে সহ-সভাপতি (ভিপি) আব্দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) মো: আবু বাকের মজুমদার সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী হলেন আশরেফা খাতুন। অন্যান্য পদে রয়েছেন- সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক নাহিয়ান ফারুক, সমাজসেবা সম্পাদক মহির আলম, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক মো: হাসিবুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাকিব, ক্রীড়া সম্পাদক আল আমিন সরকার, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক আনিকা তাহসিনা, কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক : মিতু আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক : আহাদ বিন ইসলাম শোয়েব, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক : সাব্বির আহমেদ, ক্যারিয়ার ও উন্নয়ন সম্পাদক : রেজওয়ান আহম্মেদ রিফাত, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক : মো: ঈসমাইল হোসেন রুদ্র। সদস্য পদে ১৩ জন প্রার্থী হলেন- মো: মাসউদুজ্জামান, ফেরদৌস আইয়াম, ইসমাঈল, তাপসী রাবেয়া, মো: আরমানুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, রিফতি আল জাবেদ, আশরাফ অনিক, রওনক জাহান, মাহফুজা নওয়ার নওরীন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আরিফুর রহমান ও ফেরদৌস আলম।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব জাহিদ আহসান বলেন, ‘গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে কোনো প্রার্থী দিচ্ছি না। আমরা জুলাই-এর বাঘিনী তন্বী এর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ এই পদে কোনো প্রার্থী রাখিনি।’
প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী আব্দুল কাদের বলেন, জুলাই-এর চেতনাকে ধরে আমরা প্যানেলটি একটি ইনক্লুসিভ প্যানেল আকারে সাজিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোন দল কি দিয়েছে সেটা খেয়াল করে না বরং তারা একটি অভয় ও আস্থার জায়গা চায়। আমরা আগামী দিনে এই শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে তাদের আস্থার জায়গায় আসতে চাই।
বিতর্ক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা : গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার অভিযোগ করেন, ‘ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী মনোনয়ন নেয়ার সময় আচরণবিধি ভেঙেছেন। অথচ নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেয়নি।’
অন্য দিকে ছাত্রদল বলছে, তারা শিক্ষার্থীদের আস্থা ফেরাতে কাজ করবে এবং ডাকসুকে দলের শাখা হিসেবে ব্যবহার করবে না।
সানজিদার অবস্থান : নিজের সম্মানে পদ ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সানজিদা আহমেদ বলেন, ‘যারা আমাকে সম্মান জানিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে আমি লড়াই করেই জিততে চাই। আমার গবেষণা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে চাই।’
বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচন শুধু একটি ডাকসু নির্বাচন নয়; এটি ছাত্র আন্দোলনের চেতনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ। শিক্ষার্থীরা এখন অপেক্ষা করছে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য- যেখানে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের শিক্ষার্থীবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
বামপন্থী তিন ছাত্র সংগঠনের যৌথ প্যানেল ঘোষণা : ডাকসু নির্বাচনে যৌথ প্যানেল ঘোষণা করেছে তিনটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন। ছাত্র সংগঠনগুলো হলো ছাত্র ইউনিয়ন (মাহির-বাহাউদ্দিন), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) ও ছাত্রলীগ-বিসিএল (বাংলাদেশ জাসদ)।
‘অপরাজেয় ৭১ অদম্য ২৪’ নামের এই প্যানেলে মো: নাইম হাসানকে (হৃদয়) সহ-সভাপতি (ভিপি), এনামুল হাসান অনয়কে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও অদিতি ইসলামকে সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্যানেল ঘোষণা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্যানেল ঘোষণা করেন ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা।
১৫ সদস্যের এই প্যানেলে চার প্রার্থীকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জনের নাম প্রকাশ করেছেন প্যানেলটির উদ্যোক্তারা। এই দুইজনের একজন হলেন ডাকসু নির্বাচনে গবেষণা ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বী। তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত হয়েছিলেন। আরেকজন কমনরুম, পাঠকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে প্রার্থী সুর্মী চাকমা।
এই প্যানেলের অন্য প্রার্থীরা হলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ফাহমিদা আলম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে শাকিব মাহমুদ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদে আবদুল্লাহ ইবনে হাসান (জামিল), ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে মাসফিকুজ্জামান তাইন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে মিনহাজুল ইসলাম ফারহান এবং সদস্য পদে তর্পিতা ইসলাম অব্ধি, জুনাইদ হোসেন ও মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। এ ছাড়া একটি সদস্য পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ নামে পৃথক যৌথ প্যানেল ঘোষণা করেছে বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। ওই প্যানেলে শেখ তাসনিম আফরোজকে ভিপি, মেঘমল্লার বসুকে জিএস ও জাবির আহমেদ জুবেলকে এজিএস পদে প্রার্থী করা হয়েছে।
নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই প্যানেলে ছাত্র ইউনিয়ন (মাহির-বাহাউদ্দিন), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) ও ছাত্রলীগ-বিসিএলেরও (বাংলাদেশ জাসদ) থাকার কথা ছিল। কিন্তু পদ নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় তারা আলাদা প্যানেল করেছে।
ডাকসুর ২৮ পদে ৫০৯টি ও হল সংসদে ১ হাজার ১০৯টি মনোনয়নপত্র জমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা নেয়ার সময় শেষ হয়েছে। গতকাল বুধবার ছিল মনোনয়নপত্র জমা নেয়ার শেষ দিন।
ডাকসুর ২৮টি পদের বিপরীতে মোট ৫০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। এর আগে ডাকসুর জন্য বিক্রি হয়েছিল ৬৫৮টি মনোনয়নপত্র। তবে ১৪৯টি মনোনয়নপত্র জমা হয়নি।
এ ছাড়া হল সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৮টি হলে মোট ১ হাজার ১০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৪২৭টি মনোনয়নপত্র। জমা হয়নি ৩১৮টি মনোনয়নপত্র।
হলভিত্তিক মনোনয়নপত্র জমার পরিসংখ্যান নিচে দেয়া হলো
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ৭০টি, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৩১টি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৬২টি, জগন্নাথ হলে ৫৯টি, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৬৫টি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৮১টি, রোকেয়া হলে ৪৫টি, সূর্যসেন হলে ৭৯টি, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৬৫টি, শামসুন নাহার হলে ৩৬টি, কবি জসীম উদ্দীন হলে ৭০টি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৭৮টি, শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৬৮টি, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩৬টি, অমর একুশে হলে ৮১টি, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৪০টি, বিজয় একাত্তর হলে ৭৬টি এবং স্যার এ এফ রহমান হলে ৬৭টি।