বিশেষ সংবাদদাতা
এই মুহূর্তে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে একদমই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল বা আরো যারা আছে সবার মধ্যে মীমাংসা হবে। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা রয়েছে, পাশাপাশি বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এই বিরোধে একপ মনে করছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট ও সাধারণ নির্বাচন একই দিন হলে পতিত স্বৈরাচারের সাথে যোগসাজশ করে গণভোটে নেতিবাচক ভোট দিয়ে জুলাইবিপ্লবকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। অন্যপ মনে করছে সাধারণ নির্বাচনের আগে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে গণভোট হলে কোনো অজুহাত তুলে বিপ্লবী সরকার গঠন করে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করা হতে পারে। এই অবিশ্বাস ও প্রান্তিক ধারণার কিভাবে অবসান ঘটানো যেতে পারে, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিএনপির একটি প মনে করছে ঐকমত্য কমিশন যেহেতু গণভোটের দিন তারিখ নির্ধারণের বিষয়টি সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে, সেহেতু এ বিষয়ে সরকারের দেয়া সময়ে ঐকমত্য না হলেও সরকার গণভোট ও নির্বাচন একই দিন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। অন্য একটি প মনে করছে আট দল যেভাবে রাজপথে ক্রমবর্ধমান কর্মসূচি দিচ্ছে, তাতে ঐক্যের প্রয়াস না থাকলে মাঠের অস্থিরতায় নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় দেশের অভিভাবক হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি সমঝোতার উদ্যোগ নিলে সব পক্ষ স্বাগত জানাবে।
শেষ পর্যন্ত মীমাংসা না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত কী হতে পারে সে বিষয়েও একাধিক মত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ধারণা অনুসারে- সরকার দু’টি বিবদমান পক্ষের মাঝামাঝি একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারে। আট দলের দাবি অনুসারে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে গণভোট করা হলে সাধারণ নির্বাচনের আগে লম্বা সময় থাকবে এবং এ সময়ে যেকোনো ঘটনা ঘটিয়ে নির্বাচন বানচাল করার অবকাশ থাকতে পারে। আর একই দিন নির্বাচন করা হলে বিএনপি গণভোটের বিপক্ষে অবস্থান নিলে আওয়ামী সমর্থকরা জুলাইবিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্য তাদের সমর্থন দিয়ে বসতে পারে। এ অবস্থায় এমন একসময় গণভোট দেয়া হতে পারে, যে সময়ে নির্বাচন থেকে পিছিয়ে আসা আর কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সে বিবেচনায সাধারণ নির্বাচনের পাঁচ-সাত দিন আগে গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হতে পারে। এতে দু’টি নির্বাচনের জন্য আলাদা প্রস্তুতিরও সেভাবে প্রয়োজন হবে না। সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে, নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে।
মীমাংসার সম্ভাব্য যেসব কারণ : জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐক্য হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদীরা মনে করেন নানা কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধের ফয়সালা হয়ে যাবে। প্রথমত, জুলাই সনদ ইতোমধ্যেই স্বার হয়েছে বা স্বারের পথে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার-চাহিদা ও নির্বাচনী সময়সূচি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। যেমন কিছু দল বলছে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে সনদ অনুযায়ী নির্বাচন চায়। যদি দলগুলো দেখে সনদ বাস্তবায়নে অংশ নেয়া তাদের জন্য রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করে (যেমন তরুণ ভোটার, নতুন রাজনৈতিক ইমেজ) তা হলে তারা সক্রিয়ভাবে মীমাংসার দিকে যেতে পারে।
মীমাংসায় বাধা ও ঝুঁকি : সনদ-বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও সময়সীমা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বিএনপি বলেছে যে সংবিধানের ওপর সনদকে অগ্রাধিকার দেয়া হলে সেটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হবে। এ ছাড়া দলগুলোর মধ্যে ‘কিভাবে’ ও ‘কবে’ সনদ বাস্তবায়ন হবে- এই দিক থেকে মিল নেই। কিছু বামপন্থী বা সংযুক্ত দল (উদাহরণস্বরূপ নাগরিক পার্টি) সনদ-স্বার থেকে দূরে রয়েছে বা শর্ত পূরণ হলে সাড়া দেয়ার অবস্থানে রয়েছে। বাস্তবায়ন আদেশ, আইন প্রণয়ন প্রভৃতি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি বা সময়সূচি নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এসব দিকে সমঝোতার পথে নেতিবাচক সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
বিশ্লেষকদের অনুমান : বিশ্লেষকদের মতে, মীমাংসার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে; কারণ রাজনৈতিক চাপে ও নির্বাচনী সময়সূচির সঙ্কটে দলগুলো নিজস্ব অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসতে পারে। তবে সম্পূর্ণ মীমাংসা অর্থাৎ সব দল একমত হয়ে কার্যকর বাস্তবায়ন-মডেলে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম মনে হয়। কারণ বিতর্কিত দিকগুলো এখনো সে রকমই রয়েছে।
এ েেত্র তিনটি সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে- মডেল ১ (সফল সমঝোতা) : জামায়াতসহ অন্য দলগুলো যে মধ্যস্থতাকারী চান, তা সম্ভব হলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোও অংশ নিতে পারে। একমত হলে সনদ-বাস্তবায়ন নিয়ে একটি রাজনৈতিক সহমত সৃষ্টি হতে পারে, যা পরবর্তী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মডেল ২ (আংশিক সমঝোতা) : হয়তো বিএনপি অংশ নেবে না বা পূর্ণ সমঝোতা না হলে, কিছু নির্দিষ্ট ধারা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে চুক্তি হতে পারে, কিন্তু পুরোপুরি সমাধান মেলার আশা কম।
মডেল ৩ (বিরোধ অব্যাহত) : যদি বিএনপি বা বড় কোনো অংশগ্রহণকারী দল সনদ-বাস্তবায়নের ধারা মানতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে বর্তমান বিরোধ অব্যাহত থাকতে পারে এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা বাড়তে পারে।
অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, মডেল ২ (আংশিক সমঝোতা) সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়; অর্থাৎ সনদ-বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে থাকা কিছু ধারা নিয়ে আপস হতে পারে, তবে পুরোপুরি বিরোধ শেষে মীমাংসা হওয়া এখনই নিশ্চিত নয়।
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ (জুলাই সনদ-বাস্তবায়ন) প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অবস্থানে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কে। দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে সনদে অংশ নিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন-ধারা ও নির্দেশিকায় নির্দিষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অক্টোবর ১৭-এ সনদ স্বার অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল। তবে বিএনপি অভিযোগ করেছে যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বা মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় ‘প্রতারণা’ হচ্ছে; অর্থাৎ সমর্থন রয়েছে কিন্তু পূর্ণ বিশ্বাস নেই- দল এখনো ‘মীমাংসার জন্য আলোচনায় খোলা’ রয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সনদ-স্বার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু স্বার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় তাদের সংশয় বা শর্ত ছিল। দলটি জানিয়েছে, তারা স্বারের জন্য প্রস্তুত কিন্তু ‘ড্রাফট পায়নি’, বাস্তবায়ন ও ধারা নিয়ে তারা নিশ্চিত নয়। পরে তারা সনদে স্বাক্ষর করেছে। আবার আটদলীয় জোট-আলাপের মাধ্যমে সনদ-বাস্তবায়ন ও রেফারেন্ডামসহ দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে; অর্থাৎ জামায়াতের অবস্থান ‘রূপ নিয়েছে সক্রিয় দাবিদার’ হিসেবে- স্বারসহ কিন্তু ধারা ও রূপায়ণে শঙ্কা প্রকাশে। আটদলীয় ফ্রন্ট (ইসলামপন্থী বা সংস্কারমুখী) সনদ-বাস্তবায়নের দাবিতে সক্রিয়; জোট হিসেবে স্মারকলিপি ও আন্দোলন ঘোষণা করেছে। এসব দল দাবি করছে : ‘সনদ বাস্তবায়নের আদেশ’, ‘নভেম্বরে রেফারেন্ডাম’, ‘নির্বাচন পূর্বে গণভোট’সহ পাঁচ দফা। তারা মূলত সনদ-বাস্তবায়ন েেত্র কঠোর অবস্থান নিয়ে রয়েছে; অর্থাৎ সমর্থন নয়, বরং প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগের প্রস্তুত। তবে তারা ধাপে ধাপে নির্বাচন কৌশল, জোট সম্ভাবনা অথবা নিজের রাজনৈতিক চাহিদা অনুযায়ী রূপরেখা পরিবর্তন করতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদ-স্বারে বিরত ছিল; তারা দ্বৈত কৌশল নিয়েছে- এক দিকে নিজস্ব নির্বাচন প্রস্তুতি, অন্য দিকে সনদ-বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট শর্ত বা সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় রাখছে। সনদ স্বারের সময় এনসিপি উপস্থিত ছিল না। দলটি বলেছে তারা এককভাবে নির্বাচন করবে, তবে যদি ‘সনদ-সংস্কার বাস্তবায়নের েেত্র নীতিগত মিল হয়’ তাহলে সমঝোতা করা হতে পারে। এ কারণে তাদের অবস্থান ‘আংশিক অপোমূলক ও কৌশলগত’ বলা যায়।
বড় দু’টি দল (বিএনপি ও জামায়াত) সনদ-প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে, তবে বাস্তবায়ন-দৃষ্টিকোণের ক্ষেত্রে এখনো কিছু শর্ত বা সংশয় সক্রিয় রয়েছে। ইসলামপন্থী ও সংস্কারমুখী আটদলীয় জোট সনদ-বাস্তবায়নকে সামনে রেখে বেশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে- এটি সনদ শুধু স্বার নয়, কার্যকর রূপ চাইছে। এনসিপি এমন একটি দল যেখানে ‘নিশ্চিত সমর্থন নয়, তবে সম্ভাব্য সমঝোতার উপায়’ খোলা রেখেছে, তার সাথে নিজস্ব নির্বাচন পরিকল্পনা রয়েছে-
অর্থাৎ পূর্ণ ঐক্য বা একক সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি; দলগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থ ও রাজনৈতিক পরিপ্রেতি অনুযায়ী অবস্থান নিলেও সমঝোতার পথে এখনো অনেক প্রশ্ন বিদ্যমান। এত কিছুর পরও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন- সব সংশয়ের নির্বাচনমুখী ইতিবাচক সমাধান হবে।



