সাক্ষাৎকার

সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে রক্তাক্ত জুলাইয়ের সাথে বেঈমানী

ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের

“দেশের অধিকাংশ মানুষ ও রাজনৈতিক দল সংস্কার বাস্তবায়ন চায়। তারা নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার পক্ষে ও এর বাস্তবায়ন চায়।”

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের
ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের |নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, সংস্কার নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ জরুরি। জামায়াতের পক্ষ থেকে আমি সব দলকে বিষয়টি নিয়ে ইন্টারপার্টি ডায়ালগের আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ সংস্কার ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিয়ে, বাস্তবায়ন না করে নির্বাচনে গেলে তা হবে রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলনের সাথে বেঈমানী। জামায়াত নেতা মোহাম্মদ তাহের বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ ও রাজনৈতিক দল সংস্কার বাস্তবায়ন চায়। তারা নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার পক্ষে ও এর বাস্তবায়ন চায়। যদি দলগুলো এ নিয়ে ঐকমত্যে আসতে না পারে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এটি বাস্তবায়ন করা। কারণ এটা তাদের কমিটমেন্ট যে তারা সংস্কার করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়নের যেসব পদ্ধতিগুলো দেয়া আছে, সেগুলোর মধ্য থেকে একটা চয়েস করে আস্থার সাথে সরকারকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নাই।

নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডা: তাহের এসব কথা বলেন। তিনি জানান, আইনজীবী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নির্বাচনের আগেই দেয়া সম্ভব। প্রথমে বিএনপি বলে যে এ সরকারের পক্ষে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, পরবর্তী সরকারে যারা যাবে তারাই সেটা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সংস্কারে যদি আমরা একমতই হই তো হোয়াই নট নাও, এটা বাকি কেন রাখব, যারা ক্ষমতায় যাবে তারা যে সংস্কার বাস্তবায়ন করবে এ নিশ্চয়তা কোথায়?

নয়া দিগন্ত : নির্বাচনের আগে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে তো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা বেড়ে যাওয়ার কথা।

ডা: তাহের : অবশ্যই আস্থা বাড়বে, রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আসবে, মানুষ সংস্কারের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে। সংস্কার এখনি করার জন্যই তো কমিটি করা হয়েছে। যদি এটা পরবর্তী সরকারের করার প্রশ্নটা আসে, তাহলে এখন এ কমিটির কি প্রয়োজন ছিল, আগামী সরকার এসেই তো একটা নতুন কনসাস কমিটি গঠন করতে পারত। যারা এ কথা বলছেন তারা সংস্কারের ব্যাপারে আন্তরিক আছে বলে আমরা মনে করি না।

নয়া দিগন্ত : সংস্কার নিয়ে ধোঁয়াশা কি এখান থেকেই তাহলে শুরু?

ডা: তাহের : সমস্যাটা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। সংস্কার প্রসেসে একমত হওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যাটা শুরু হয়েছে। কারণ প্রতিটা বিষয়ে আমরা দেখি যে একটা দল প্রায় ‘না’ করার পর্যায়ে থাকছে। জনমত সরাসরি ব্রডকাস্ট হয় এবং অন্যদের কথাবার্তা সব মিলিয়ে তারা অনেকগুলো বিষয়ে একমত হয়েছে। এবং সেটা একটা কৌশল, কারণ তারা দেখে যে দ্বিমত পোষণ করলেই জনগণ আরো বেশি করে তাদের ভিন্নভাবে চিত্রিত করবে। এ জন্য তারা পাবলিক সেন্টিমেন্টকে ভয় পেয়ে একমত হয়েছে আবার নোট অব ডিসেন্টও দিয়ে রেখেছে। আমরা যদি একমত হই তাহলে আবার নোট অব ডিসেন্ট কেন? তাদের সমস্ত কৌশলেই তারা চেষ্টা করছে এটাকে অ্যাভয়েড করা যায় কি না। যেহেতু মেজরিটি দল চাচ্ছে, জনগণ চাচ্ছে এজন্য ওদের সব কৌশল এখানে কার্যকর হচ্ছে, এটা মনে হচ্ছে না।

নয়া দিগন্ত : জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনি জটিলতা আছে কি?

ডা: তাহের : বিষয়টি নিয়ে কমিশন অনেক বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে। বারবার বলেছে। জামায়াতে ইসলামী একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে দিয়েছে। সংস্কারগুলো এখন জুলাই সনদ হিসেবে অভিহিত করছি তার আইনি ভিত্তি দেয়া এখনই সম্ভব বলে আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির মধ্যে সাবেক বিচারপতিরা আছেন, বড় বড় আইনজীবী আছেন, তারাও বলছে এটা করা সম্ভব।

নয়া দিগন্ত : আপনি নিজেও তো বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সাথে কথা বলেছেন

ডা: তাহের : হ্যাঁ আমি নিজেও আইনজীবীদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তারা একই কথা বলেছেন। আমরা লিখিতভাবে সরকারকে এ পদ্ধতির কথা জানিয়েছি। সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মূলত বাস্তবায়ন পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে আলোচনায় পাঁচটি প্রস্তাব এসেছে। একটি হচ্ছে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, দ্বিতীয় প্রস্তাব এসেছে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে। তৃতীয় প্রস্তাব এসেছে স্পেশাল কনস্টিটিউশনাল ডিক্লেয়ারেশনের মাধ্যমে। জামায়াতের পক্ষ থেকে এটি দেয়া হয়েছে। এরপর প্রস্তাব এসেছে যে একটা কমিটমেন্টের যে যারা ক্ষমতায় যাবে তারা এটা বাস্তবায়ন করবে। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর রোববার এ নিয়ে ফের বৈঠকে বসব আমরা। সুতরাং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়া সম্ভব নয় এটা একটা ধূম্রজাল। এখনই নয় কেন, এর কোনো স্পষ্ট জবাব নাই। সবমিলিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : তাহলে এ অনিশ্চয়তা থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

ডা: তাহের : আমরা যেটা মনে করি যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাদাভাবে নিজেদের ভেতরে আলোচনা হওয়া দরকার। একটা ইন্টারপার্টি ডায়ালগের মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা যায় কি না, এটা খুব জরুরি। আস্থার যে সঙ্কট সেটা দূরীভূত করার জন্য কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলোর কাছে আমি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই তারা যদি এগ্রি করে তাহলে ইন্টারপার্টি ডায়ালগের উদ্যোগ নিতে আমরা প্রস্তুত আছি।

নয়া দিগন্ত : সংস্কার নিয়ে মতপার্থক্য কি এতে কমে আসবে?

তাহের : এতে দূরত্ব কমবে। সবাই ক্লোজ লেভেলে আলোচনা করে আরেকটু বেটার কিছু করার চেষ্টা করবে।

নয়া দিগন্ত : নির্বাচনের দিন তো ঘনিয়ে আসছে...

ডা: তাহের : হ্যাঁ তাতো আসছেই। মেজরিটি পিপল, মেজরিটি পার্টিস নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার পক্ষে ও বাস্তবায়ন চায়। তারা এর পক্ষে এবং আমরা মনে করি যদি দলগুলো একটা ঐকমত্যে আসতে না পারে তাহলে এটা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এবং এটা তাদের কমিটমেন্ট যে তারা সংস্কার করবে, যেসব পদ্ধতিগুলো দেয়া আছে সেগুলোর মধ্য থেকে একটা চয়েস করে আস্থার সাথে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নাই।

নয়া দিগন্ত : এ ছাড়া তো যেনতেন একটা নির্বাচন দিলে পুরনো রাষ্ট্রকাঠামোই থেকে গেল...

ডা: তাহের : এটার কোনো অল্টারনেটিভ নাই। এটা ছাড়াই যদি তারা নির্বাচন করতে চায় তাহলে তো আমরা আওয়ামী লীগের সেই যুগে আবার ফিরে যাবো। যেটা রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলনের সাথে বেঈমানী হবে। সংস্কার নিয়ে যেসব প্রস্তাব এসেছে সরকার সেগুলোর মধ্যে যেটিকে মোর ইফেক্টিভ মনে করবে সেইভাবে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

নয়া দিগন্ত : নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও তো প্রশ্ন উঠছে।

ডা: তাহের : সংবিধানে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন হবে এভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু কোন নিয়মে হবে সেটা নিয়ে সংবিধানে কিছু নাই। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশন খুবই অযাচিতভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে পিআর সংবিধানে নাই বলে একটা বিভ্রান্তি তৈরি করছে। তাদের কথায় এটা বুঝা যায় প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে এটা সংবিধানে আছে। এটা একেবারেই অসত্য, অযৌক্তিক এবং বিভ্রান্তিকর। আমরা আগেও এটার প্রতিবাদ জানিয়েছি, আমি এখনো প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ইলেকশন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্য তাদের এ বক্তব্য প্রত্যাহার জরুরি।

সরকারের উচিত ছিল এ বিষয়ে রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করা। ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ করা এবং তারপর রোডম্যাপ দেয়া। কিন্তু সরকার মনে হয় তড়িঘড়ি করে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়েছে। এবং বিষয়গুলো আনসেটেল রেখেই রোডম্যাপ ঘোষণা করে আরেকটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচনের আগে এ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ট্র্যাডিশনাল রীতি, সবসময় এটা হয়ে এসেছে। কিন্তু এবার এটা পুরোপুরি ব্যত্যয় ঘটেছে। বিশেষ করে কোনো একটি বিশেষ দলের ফেভারে লন্ডন গিয়ে এ রকম ডেট ঘোষণা একধরনের লেভেল প্লেইং ফিল্ডের যে জিনিসটা আছে এটাকে লঙ্ঘন করা। রোডম্যাপও মনে হয় যেকোনো একটা জায়গা থেকে প্রেশারের মাধ্যমে বা ডিক্টেটিভভাবে, পদ্ধতিগত ঐকমত্যে না পৌঁছে ঘোষণা করে দেয়া নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়ার একটা অপচেষ্টা বলে মনে করি।

নয়া দিগন্ত : এমন কেন হচ্ছে, এসবের পেছনে কি বাইরের কোনো দেশ বা বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব রয়েছে?

ডা: তাহের : দ্যাখেন আমাদের দেশটাতো সব সময় একটা ধূম্রজাল এবং নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আসছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাইরের লোকেরা আর আমাদের কিছু দেশীয় দালাল মিলে একটা বিরূপ পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে। কোনো একজন লোক বলেছিল বাংলাদেশে যে পরিমাণ দালালের সংখ্যা, ভারতের চতুর্দিকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে তার অর্ধেক দালালও নাই। এটা আমাদের জন্য আনফরচুনেট। বাইরের একটা চাপ থাকতে পারে।

নয়া দিগন্ত : ভারতীয় মিডিয়া তো সচিত্র প্রতিবেদন করছে যে দেশটিতে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ ও প্রশাসনের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা মিলে নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

ডা: তাহের : এটা ভারতের খুব বাড়াবাড়ি ধরনের অপরাধ। এটা একটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তর বিষয়ে একেবারে অন্যায়ভাবে অযাচিত হস্তক্ষেপ, যেটা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইন্ডিয়া এই কাজটি মোটেও করতে পারে না। আওয়ামী লীগের পরাজয়টা ইন্ডিয়া তাদের পরাজয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। তারা মনে করে যে তার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলো তার তাঁবেদারি করবে এবং করদরাজ্য হিসেবে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখবে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করেও ভারতের একটি এক্সটেনশন দল হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে এবং জনগণও তাদেরকে সেটাভাবে। যে কারণে মানুষ তাদের বিতাড়িত করেছে। তারাও তাদের সেই পুরনো ট্র্যাকের কাজ করে যাচ্ছে। আমি মনে করি এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, আঞ্চলিক রাজনীতিতে এটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। যেটা ইন্ডিয়াকেও সাফার করতে হবে।

নয়া দিগন্ত : নেপালে গণ-অভ্যুত্থানের পর এর ধাক্কা যাতে ভারতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য দেশটির অনেক রাজনৈতিক দল ও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত বিজেপি সরকারকে সতর্ক করছে।

ডা: তাহের : ভারতের ক্ষেত্রে এখন তাওয়া গরম হয়ে আছে। যে কোনো লোক কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই এই জালেমদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। সারা বিশ্বে আমরা একটা ট্রেন্ড দেখছি যে আধুনিক ইয়াং ছেলেরা অধিকতর দেশপ্রেমিক এবং নিবর্তনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং এটা যে হতে পারে না তা বলার সুযোগ নাই।

নয়া দিগন্ত : আপনি পরিবর্তনের কথা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা দেখছি যে জামায়াত পরিবর্তনের কথা বলছে, আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসনের কথা বলছে, এটা না হলে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব?

ডা: তাহের : আমরা মনে করি এখানে আল্লাহর আইন বা শাসনের শব্দটির ব্যাখ্যার ভেতর একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং রয়েছে। আল্লাহর আইন হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য আইন। মানুষ তো আল্লাহর সৃষ্টি। সৎলোকের শাসন যে কতটা জরুরি দেশের পরিবর্তনের জন্য ডাকসু নির্বাচনে ছেলেমেয়েদের যে পরিবর্তন তা প্রমাণ করে জামায়াতে ইসলামী একটা সৎ মানুষের দল। ছাত্রশিবির একটা সৎ ছাত্রদের দল, এজন্য তারা ব্যাপক হারে তাদেরকে সমর্থন করেছে। আমরা বলছি কুরআনে মানুষের কল্যাণের যে দিকগুলো আছে সেগুলোকে প্রায়োরিটি দিয়ে একটা আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন করতে চাই।

নয়া দিগন্ত : সেদিক থেকে সাধারণ মানুষের সাথে জামায়াতের সম্পৃক্ততা কি আগের চেয়ে বেড়েছে?

ডা: তাহের : আমরা তা মনে করছি এবং তার প্রমাণ পাচ্ছি। যেখানেই আমাদের জনসভা হচ্ছে সেখানে হাজার, লাখ মানুষ আসছে। পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবে বলে আমি মনে করি না। একটা ব্যাপক পজিটিভ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের জন্য এ দেশের মানুষ এবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

নয়া দিগন্ত : ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে?

ডা: তাহের : দ্যাখেন উনসত্তরের ডাকসু নির্বাচন, সেখানে ছাত্রলীগ বিজয় অর্জন করেছিল, তার পরবর্তী সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে। এ রকম আরো উদাহরণ আছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ডাকসুর এমন প্রভাব দেখা যায়। পরে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এবারের ডাকসু নির্বাচনটা আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে আরেকটু ভিন্নমাত্রার। এ বিজয়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক সমর্থন, ফলাফলে এতবড় ব্যবধান, দ্বিগুণ ব্যবধানে জয়লাভ। অবশ্যই এ দেশের মানুষ কি চায় তার একটা প্রতিফলন এটার ভেতরে আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং মানুষ যে ন্যায়ের পক্ষে, সভ্যতার পক্ষে, সততার পক্ষে অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এটা করতে পেরেছে। এর একটা রিফ্লেকশন জাতীয় নির্বাচনে হবে নিঃসন্দেহে।

নয়া দিগন্ত : পিআর পদ্ধতিতে জামায়াত নির্বাচন চাচ্ছে, কোনো কোনো দল দাবি করছে জামায়াত নির্বাচন চায় না বা পেছাতে এটা করছে।

ডা: তাহের : প্রথমে আমরা যখন কেয়ারটেকার পদ্ধতির কথা বলেছিলাম তখনো অনেকে বলেছিল এটা একটা বিভ্রান্তিমূলক কথা। কিন্তু এখন এটা বিএনপি এক্সসেপ্ট করেছে, আওয়ামী লীগ এক্সসেপ্ট করেছে, আবার আমরা সবাই মিলে এবারো এক্সসেপ্ট করেছি। সুতরাং পুরাতন যে কথা আছে হোয়াট বেঙ্গল থিংস টুডে, ইন্ডিয়া থিংস টুমরো, ওইটার মতো পিআর যে এ দেশের সব সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়েল রিপ্রেজেন্টারি সিস্টেম সেটা আজকে যারা বুঝছে না তারা কালকে বলবে ইট ইজ দ্য বেস্ট পলিসি। আশা করি জনগণই এটাকে এক্সসেপ্ট করেছে, জরিপে ৭১ শতাংশ লোক পিআর এর পক্ষে রায় দিয়েছে। পিআর বুঝে না বললে তাহলে ৭১ শতাংশ লোক রায় দিলো কিভাবে।

নয়া দিগন্ত : মানুষের ভেতর পরিবর্তন ও গণ-আকাক্সক্ষাকে ধারণের তো কোনো বিকল্প নাই...

ডা: তাহের : ফ্যাসিবাদের পতনের পর মানুষের মনে বাংলাদেশের শাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক দলের কোড অব কন্ডাক্ট এসব বিষয়ে একটা ব্যাপক পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার পর যারা দেশ শাসন করেছিল তাদের ব্যর্থতার নিরিখে এবং পরবর্তী সরকারগুলো যারা এসেছে তারা জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এবারের পরিবর্তন একটা বিরাট গণআকাক্সক্ষা তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর স্পষ্টভাবে যে তিনটি ওয়াদা করেছিল সেগুলো হচ্ছে, ব্যাপক মৌলিক সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার, যারা খুনি, রাষ্ট্রদ্রোহী, লুটেরা ও জালিম ছিল তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, তৃতীয় ছিল জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সরকার প্রাথমিকভাবে সংস্কার করার ক্ষেত্রে একটা কমিশন গঠন করে দীর্ঘদিন ধরে নানাপর্যায়ে কখনো আলাদাভাবে কখনো একসাথে ৩১টি রাজনৈতিক দলের সাথে বসে একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছে। এটা বিরাট সফলতা এ কারণে যে বিভিন্ন মত ও ধারার ৩১টা দল বাংলাদেশের ইতিহাসে এ প্রথম একসাথে বসে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দীর্ঘসময় ধরে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছে। একে অন্যকে জানার, বুঝার সুযোগ হয়েছে এবং নিজেদের ভেতরে এক ধরনের টকিং রিলেশন বা ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিশাল অর্জন, একটা ডিভাইডেড বা নেগেটিভ রাজনীতির মধ্যে। মৌলিকভাবে অনেকগুলো বিষয়ে একমত হতে সক্ষম হয়েছি, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তা দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রশাসনিক বিষয়ে যেসব সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকার তা স্বাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়ন করছে। মৌলিক প্রায় ২০টি ধারা নিয়ে আমরা ঐকমত্য পোষণ করেছি সেগুলোর জন্য নতুন করে আইন বা সংবিধানের কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন। ঐকমত্যের বিষয়গুলোর ভেতরে প্রায় ৬-৭টি মৌলিক জায়গা আছে যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। কিন্তু নোট অব ডিসেন্টের মাধ্যমে তারা সিদ্ধান্তগুলোকে মেনে নিয়েছে। জটিলতা তৈরি হয়েছে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কিভাবে করা যায় তা নিয়ে। এর আইনি ভিত্তি কি হবে এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কি হবে এসব বিষয়ে। রাজনৈতিক দলগুলো এ জটিলতা নিরসনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান করবে বলে আমি আশাবাদী।