- আজ মন্ত্রীপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
- খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করবেন
- দুই দেশের সংস্কৃতি বিনিময়ের সম্ভাবনা
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে গতকাল দুপুরে ঢাকা এসেছেন। এক যুগেরও বেশি সময় পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এলেন। এর আগে ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় এসেছিলেন।
বিশেষ বিমানে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার ও ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ইকবাল হোসেন খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইসহাক দারের ঢাকা সফরকে ঐতিহাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করছেন। এটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এই সফরের সময় বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের সাথে ইসহাক দার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবেন।
ঢাকায় পৌঁছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন। তিনি প্রথম বৈঠকটি করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সাথে। পাকিস্তান হাইকমিশনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে এনসিপি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। বৈঠকে ইসহাক দার এনসিপির সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত ভিশনের প্রশংসা করেন। তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এনসিপি নেতৃবৃন্দ গত বছর জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ইসহাক দারকে অবহিত করেন। উভয় পক্ষ আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করে।
বৈঠক শেষে আখতার হোসেন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ইসহাক দারের সাথে এনসিপির সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছে। পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে আমাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। আমরা বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা বলেছি, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আগে যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল সেখান থেকে উন্নতির সুযোগ আছে। তবে ’৭১ এর ইস্যুটি অবশ্যই সুরাহা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থসেবাসহ দুই দেশের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক হবে ভ্রাতৃত্বের, কোনো হেজিমনি (আধিপত্য) থাকবে না।
এরপর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। এতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের উপায় এবং আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা হয়। কঠিন ও কষ্টকর সময়ে জামায়াত নেতাকর্মীদের সাহসিকতা ও দৃঢ়তার প্রশংসা করেন ইসহাক দার।
এ সময় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের জানান, আলোচনায় দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক চালু করাসহ ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা একপেশে ছিল। এখন বাংলাদেশ সরকারসহ সবাই মনে করছে এ অঞ্চলের সব প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা দরকার।
জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বলেও জামায়াতের নায়েবে আমির জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত নেতা বলেন, দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো দুই দেশের সরকারের বিষয়। আমরা আশা করি সরকারি বৈঠকে সেসব বিষয় আলোচনা হবে। রাতে জামায়াতের আমিরকে দেখতে তার বাসায় যান পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ইসহাক দার আজ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে তার বাসভবনে দেখা করবেন। গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপির নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
কর্মসূচি অনুযায়ী, সফরের দ্বিতীয় দিনে আজ রোববার ইসহাক দার একটি প্রাতঃরাশ বৈঠক করবেন। এ বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। এরপর বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। আর পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন ইসহাক দার। প্রতিনিধিপর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে দুই নেতা একান্ত বৈঠকে মিলিত হবেন।
বৈঠকে ব্যবসা, বিনিয়োগ, সংযুক্তি, কৃষিসহ দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে। এতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া ও অভিন্ন স্বার্থের ওপর জোর দেবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মনে করে, পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের কারণে সম্পর্ক যেখানে এসেছে, তা এগিয়ে নিতে হলে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহা করা প্রয়োজন। আর অমীমাংসিত বিষয়গুলো হলো, একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়া ও স্বাধীনতার সময়ে অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা দেয়া।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত চলাচলের চুক্তি, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদেশের সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস এবং পাকিস্তানের এপিপির মধ্যে সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হবে। এরপর পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেবেন। ইসহাক দার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।