বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প আবারো নতুন এক সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর দেশটির ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থা ও আগ্রহ বেড়েছে। ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান থেকেও তৈরী পোশাকের ক্রয়াদেশ এখন বাংলাদেশে চলে আসছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে দেশটি থেকে পোশাক আমদানি অনেকটাই ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। একই সাথে চীনের ওপর আগের চাপের পাশাপাশি নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় মার্কিন ক্রয়াদেশ চীন থেকেও অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ধাপে ধাপে চীন থেকে তাদের সরে আসছিল। তার সাথে নতুন শুল্ক চাপ যোগ হওয়ায় তাদের সরে আসার গতি আরো বেড়েছে। এর একটি বড় অংশ যাচ্ছে ভিয়েতনামে। তবে ভিয়েতনামের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় সেখান থেকে মধ্যম দামের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে চলে আসছে।
তথ্যে দেখা যায়, শুধু ভারত বা চীন নয়, পাকিস্তান থেকেও সম্প্রতি ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, পাকিস্তানে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, তুলা উৎপাদন কমে যাওয়া এবং ব্যাংকিং জটিলতার কারণে সেখানকার তৈরী পোশাক রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাকিস্তান মূলত নিজেদের তুলা দিয়ে তৈরী পোশাক রফতানি করে থাকে। এবার তুলা উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। ফলে দেশটির উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। তা ছাড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা এবং ঋণপত্র খোলায় জটিলতার কারণে অনেক মার্কিন ক্রেতা এখন ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছে। এর একটি অংশ সরাসরি বাংলাদেশে চলে আসছে।
তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১.৬৬ শতাংশ বেড়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক বাজারে দ্রুততম প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী সরবরাহকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয়েছে। সর্বশেষ বাণিজ্য তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪.৯৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানি বেড়েছে মাত্র ৪.৯৬ শতাংশ, যা বৈশ্বিকভাবে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৮০ বিলিয়ন ডলার। পরিমাণের বিচারে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক আমদানি বেড়েছে ২০.৩৩ শতাংশ। একই সাথে ইউনিট মূল্য বেড়েছে ১.১১ শতাংশ।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মোহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বৈশ্বিক ক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সোর্সিং গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পোশাক রফতানি ২১ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশ মূল্য ও পরিমাণ দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। একসময় বৈশ্বিক পোশাক রফতানিতে একচেটিয়া নেতৃত্ব দেয়া চীনের যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ২১.০১ শতাংশ কমেছে (মূল্যে) এবং পরিমাণে প্রায় ১৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর গড় ইউনিট মূল্যও কমেছে ৬.০৫ শতাংশ।
অন্য দিকে কয়েকটি এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণ। ভিয়েতনাম ১৬.৯৪ শতাংশ, ভারত ১৬.১০ শতাংশ, পাকিস্তান ১১.৮১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ১৬.৮০ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া ২৪.৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। এর মধ্যে কম্বোডিয়া সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে, তাদের রফতানি পরিমাণ বেড়েছে ৩১.১১ শতাংশ। বাংলাদেশের অবস্থান তার ঠিক পরেই, ২০.৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে।
রুবেল বলেন, “বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা চীনের বাইরে সোর্সিং বৈচিত্র্য করছে, আর এর অন্যতম প্রধান সুবিধাভোগী বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতামূলক দাম, সঠিক কমপ্লায়েন্স ও স্থায়িত্বশীলতার মানদণ্ড মেনে চলা; এই তিনটি কারণে আমরা চীনের পরিবর্তে নতুন পাচ্ছি।” শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কেবল চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনার ফল নয়। গত এক দশকে গ্রিন ফ্যাক্টরি, শ্রমিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক কমপ্লায়েন্সে ব্যাপক বিনিয়োগ দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় সোর্সিং হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাধিকসংখ্যক গ্রিন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির দেশ। বৈশ্বিক ক্রেতারা ক্রমেই স্থায়িত্বশীল সরবরাহ চেইনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আর আমাদের শিল্প সেই চাহিদা পূরণ করছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, বাড়তি ক্রয়াদেশ এলেও তারা হুট করে সব গ্রহণ করছে না। সক্ষমতার অতিরিক্ত আদেশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আবার তাৎক্ষণিকভাবে বড় কোনো বিনিয়োগেও যাচ্ছেন না। কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শুল্ক কাঠামো যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো সঙ্কটও দেখা দিতে পারে। তাই সতর্ক কৌশলই এখন সর্বোত্তম পথ।
বিজিএমইএর একাধিক পরিচালক জানান, তারা চান টেকসই প্রবৃদ্ধি। এ জন্য এখন অতিরিক্ত ঝুঁকি না নিয়ে ধীরে ধীরে সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক। তাই গুণগত মান ও সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য। তবে বাড়তি নেয়ার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থায়ন। অনেক পোশাক কারখানা নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র খুলতে পারছে না। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠান অর্ডার নিতে পারছে না। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করেছে। এতে কিছুটা স্বস্তি এসেছে, তবে উদ্যোক্তাদের দাবি এ ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “একটি অর্ডার শুরু থেকে শেষ করতে কয়েক মাস সময় লাগে। হঠাৎ করে নীতি পরিবর্তন হলে আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। তাই আমরা চাই সরকার নগদসহায়তা অব্যাহত রাখবে এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি বজায় রাখবে।”
শিল্প বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এলে বাংলাদেশ শুধু রফতানি বাড়াতেই পারবে না, বরং সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ জনবল তৈরি ও উৎপাদন বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “বৈশ্বিক বাণিজ্য এখন অনেকটাই ভূ-রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকে দ্রুত অনুমোদন দিলে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে নজর দিলে বাংলাদেশের পোশাক খাত আরো শক্তিশালী হবে।” যদিও এখন ক্রয়াদেশ বাড়ছে, তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এ ধারা দীর্ঘমেয়াদি হবে কি না, তা অনিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ যেকোনো সময় নীতি পরিবর্তন করতে পারে। তা ছাড়া মুদ্রার ওঠানামা, কাঁচামালের দাম ও ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন নতুন চ্যালেঞ্জ ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ক্রেতা ফোরামের একজন প্রতিনিধি বলেন, “আমরা দেখছি বর্তমানে বাংলাদেশ একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কিন্তু টেকসইভাবে এই সুবিধা ধরে রাখতে হলে উৎপাদন বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু টি-শার্ট বা সোয়েটার নয়, ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যে বেশি জোর দিতে হবে।” বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প এক দিকে যেমন নতুন বাজার সুযোগ পাচ্ছে, অন্য দিকে বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি।
ভারতের ওপর পাল্টা শুল্ক, পাকিস্তানের উৎপাদন সঙ্কট ও চীনের বাড়তি খরচের ফলে বাংলাদেশ ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। কিন্তু একইসাথে অর্থায়নের সঙ্কট, নীতিগত অনিশ্চয়তা ও বৈশ্বিক বাজারের চাপও বিদ্যমান।