সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারকে কেউ কখনো দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মনে করেনি। ক্যাসিনোতে যেমন সারা দিন জুয়া খেলে দিনশেষে মুনাফা লুটে নেয়া যায় ঠিক সেভাবেই বিগত দিনগুলোতে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করেছে। এর ফলে দিনদিন পুঁজিবাজার পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট রাজনৈতিক আলাচনা : দর্শন ও অনুশীলন’-শীর্ষক এক সংলাপে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। গতকাল রাজধানীর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ টাওয়ারের সম্মেলন কক্ষে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এ সংলাপে কী নোট পেপার উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের পুঁজিবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে এ মুহূর্তে দরকার পলিটিক্যাল ওনারশিপ। অর্থনীতির একটি প্রধান খাত হিসেবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে সরকার এর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে। পুঁজিবাজারকে কার্যকর করা গেলে সরকারকে সামান্য অর্থের জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। আজ সামান্য চার বিলিয়ন ডলারের জন্য আমাদেরকে আইএমএফসহ অন্যান্য বিদেশী ঋণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এ বাজারকে বিনিয়োগ উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে বিদেশীরা এমনিতেই নিজেদের অর্থ নিয়ে আমাদের কাছে ধরনা দেবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রতি বছর ভিয়েতনামে ৩০০ বিলিয়ন ডলার যাচ্ছে। আর আমাদের দেশে কত বিনিয়োগ আসছে তাতো সবাই জানে। এর কারণ আমরা এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে পারিনি।
তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে পুঁজিবাজারের ওনারশিপ নেয়া হবে। এ পর্যন্ত অনলাইন ট্রেডিং, সিডিবিএলসহ পুঁজিবাজারে যত ধরনের সংস্কার করা হয়েছে তা বিএনপি সরকারের সময় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন প্রতিবছর বিশ^ বাজারে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ফান্ড পুঁজিবাজারগুলোতে যায়। আমরা ক্ষমতায় গেলে এর একটা বড় অংশ দেশের পুঁজিবাজারে আনতে পারব। ইতোমধ্যেই আমরা এ ব্যাপারে অনেকের সাথে কথা বলেছি।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য তার উপস্থাপনায় দেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ এর সাথে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার বিষয়টি তুলে আনেন। তিনি বলেন, যে পুঁজিবাজারের আয়তন মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের কম সেখানে এরই মধ্যে দু’টি বড় ধরনের বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ছোট এ বাজার থেকে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়েছে; যার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর পর ২০১০-১১ সালের বিপর্যয়ে আরো বেশি টাকা লুট করা হয়েছে এবং তা-ও বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দু’বারই সরকার এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এর রিপোর্ট কোনো দিন আলোর মুখ দেখেনি। কারণ এ কাজ যারা করেছে, তারা সবাই তখনকার সরকার ঘনিষ্ঠ।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজার হচ্ছে দেশের মানুষের সঞ্চয় তথা সম্পদের আহরণ, যা তারল্য পরিণত করে উৎপাদন সেবা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে সাহায্য করে। তবে এটি একা চলতে পারে না। এখানে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। এখানে আছে ইস্যুয়ার কোম্পানি, লিস্টেড কোম্পানি, ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি, ব্রোকার্স, সিডিবিএলসহ আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তারা কি তাদের ভূমিকাটুকু সঠিকভাবে পালন করছে? যদি তা করে থাকে তাহলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’টি বড় বিপর্যয় কিভাবে ঘটল?
তিনি বলেন, দুই বারের পুঁজিবাজার বিপর্যয়েই সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোই সক্রিয় ছিল। তাই এত বড় ঘটনার কোনো শাস্তি হয়নি। প্রতিবারই এভাবে বাজারকে লুট করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কোনো প্রতিষ্ঠান নেই অথচ তাদেরও লিস্টিং করেছেন। কারসাজি করে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন। কারসাজিকারীদের শাস্তি না দেয়া, এটাই হচ্ছে পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা। তাই টোটকা ওষুধ দিয়ে পুঁজিবাজারকে ঠিক করা যাবে না। পুঁজিবাজারের ধাক্কা অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। দীর্ঘদিন ধরে একটি আইপিও আসেনি।
পুঁজিবাজারের বর্তমান মন্দা কাটাতে এখানে যেভাবেই হোক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর জন্য পুঁজির উৎস বাড়াতে হবে। আগে বিভিন্ন সময় আইএমএফ ও এডিবির উদ্যোগে বিভিন্ন কাজ হয়েছে। এ পর্যায়েও তা অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া বাজারের গভীরতা বাড়াতে বহুজাতিক ও ভালো কোম্পানির লিস্টিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের চাহিদার সাথে জোগানের একটি ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা রাখতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগে উৎসাহের কারণ হবে।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সাথে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈঠকে পাঁচটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এখনো সেগুলো নিয়ে কোনো কাজই হয়নি। এভাবেই আমাদের সব উদ্যোগ কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো অ্যাকশন প্লান থাকে না।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান। দিন এনে দিন খাব এই প্রতিষ্ঠানের চরিত্র এটা না। এই বাজার ঠিক করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে, অচলাবস্থা থেকে বের হতে হবে। একে অপরকে আস্থায় নিতে হবে। তারপরও যদি বাজার ঠিক না হয়, তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মো: মোবারক হোসাইন বলেন, পুঁজিবাজার অর্থনীতির উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইসলামে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে সর্বদাই কথা বলা হয়েছে। বৈধ ব্যবসা ইসলামে হালাল। তিনি বলেন, জাকাত সিস্টেমের ওপর যদি আপনারা আইডিয়া নেয়ার চেষ্টা করেন এবং এর সম্পর্কে যদি গবেষণা করেন তবে এটি এটি কার্যকর করার মাধ্যমে আমরা এমন একটি ইকনোমিক সিস্টেম ডেভলপ করতে পারব যে পুরো বিশ্বে তা রোল মডেল হয়ে থাকবে। তাছাড়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনুভা জাবিন বলেন, আমরা যখন গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশের সব সেক্টর নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি বা বোঝার চেষ্টা শুরু তখন দেখছি সমস্যা খুবই সুপারফিশিয়াল। এর জন্য এই সমস্যাগুলোর গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না।
তাসনুভা জাবিন বলেন, যে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা তরুণরা দেখি, সেই দেশে বাস্তবায়নের জন্য কারো রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না। এনসিপির সবকিছু নিয়ে আলাদা এবং ত্রুটিমুক্ত পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা আশা করি, এগুলো কথায় না; কাজে বোঝাতে পারব। আমরা এসেছি মাত্র তিন মাস হয়েছে। আমাদের কথা শুনে মনে হতে পারে আমরা অন্যদের মতো স্বপ্ন দেখাচ্ছি, কিন্তু আমরা আশা করি আমরা যখন এগুলো এপ্লাই করব তখন সবার ধারণা পাল্টে যাবে।
তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাজারকে বলা হয় অর্থনীতির আয়না, সত্যি কথা হলো গত কয়েক বছর এই বাজার একটা চক্রের হাতে বন্দি ছিল। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তার মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল না। বাজারের এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে স্থায়ী পরিকল্পনা প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় বক্তারা বলেন, কারসাজিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে পুঁজিবাজারে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। ক্যাপিটাল মার্কেট হচ্ছে এলিট ক্লাসের ক্লাব। গত ৩০-৪০ বছরে এর মাত্র ১ শতাংশ গেইনার হয়েছে। যারা চুরি করেছে তারাও এলিট ক্লাসের।
বক্তারা বলেন, পুঁজিবাজারের কাজ উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীকে কানেক্ট করা, এটা হচ্ছে না। কেন হচ্ছেনা? আমি যদি আমার টাকা কোন কোম্পানিকে দেই, তখন এই কোম্পানির বিষয়ে আমার ইতিবাচক ধারণা থাকতে হবে এবং কোম্পানিটি মুনাফা আমার সাথে শেয়ার করবে সেটা বিশ্বাস রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।