অর্থনীতি ক্রমাগত চাপে- ব্যবসা স্থবির, শিল্পে সঙ্কোচন, মুদ্রাস্ফীতি উচ্চমাত্রায়, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম চরমে। কিন্তু ঠিক এই সময়েই দেশে নতুন আরো ৯ হাজার কোটিপতি আমানতকারী সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরো চমকে দেয়ার মতো তথ্য- এক বছরে কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে ৫৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি নতুন অর্থ জমা হয়েছে।
এ প্রশ্ন এখন তীব্র- যেখানে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় ভাঙছে, নিম্নবিত্ত ঋণে ডুবছে, ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ কমাচ্ছে- সেখানে এত বিপুল টাকা কারা জমাচ্ছে? এবং কেন? এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে বৈষম্যের গভীরতর ছবি- যা শুধু সম্পদের বৃদ্ধি নয়, বরং ব্যাংকিং ব্যবস্থার অদৃশ্য অসাম্য, অনিয়ম এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর উত্থানকেও উন্মোচন করে।
কোটিপতি তালিকা-সঙ্কটের মধ্যেও ৭.৫% বৃদ্ধি : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে- গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোটিপতি আমানতকারী ছিল-১ লাখ ১৯ হাজার ১৫৪ জন। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এ সংখ্যা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০ জন। অর্থনৈতিক ধসের সময় কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা প্রায় ৭.৫% বেড়ে যাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্বাভাবিক বাজারের আচরণ নয়।’
তাদের মতে- এটি দুটি জিনিস নির্দেশ করে- টাকার সুষম বণ্টন অর্থনীতিতে হচ্ছে না, বরং কেন্দ্রীভূত হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে। অর্থনীতির উৎপাদন অংশ সঙ্কুচিত, কিন্তু অদৃশ্য আর্থিক প্রবাহ বাড়ছে- এর মধ্যে সন্দেহজনক প্রবণতা আছে।
ভয়ঙ্কর তথ্য : সবচেয়ে ‘বড় কোটিপতি’ দ্রুত বাড়ছে : ৫০ কোটি টাকার উপরে আমানতকারীর সংখ্যা গত বছর ছিল ১,৮০০ জন আর এ বছর ১,৯৪৭ জন। এই ১৪৭ জন নতুন বড় কোটিপতি কীভাবে এই সময়েই ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি অর্থ জমাতে পেরেছেন- এ প্রশ্ন ব্যাংক খাতেও উচ্চারিত হচ্ছে। শুধু সংখ্যা নয়, তাদের অ্যাকাউন্টে জমা অর্থ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এটি আর্থিক বৈষম্যের সবচেয়ে বড় সঙ্কেত।
কোথা থেকে এলো ৫৫ হাজার কোটি টাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ এবং খাত-বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মিলিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস চিহ্নিত হয়-
১. বিনিয়োগ স্থবিরতায় ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে ব্যাংক- কিন্তু কার জন্য : উচ্চ সুদের পরিবেশে বড় ব্যবসায়ীরা- শিল্পে নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না বরং বিনিয়োগ তুলে এনে ব্যাংকে অর্থ রাখছে। এতে সাধারণ মানুষের নয়, কেবলমাত্র মূলধনী গোষ্ঠীর আমানত বেড়েছে।
২. টাকার অবমূল্যায়ন- লাভবান হচ্ছে কারা : ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায়- আমদানি-রফতানি নির্ভর কিছু গোষ্ঠী, আন্ডার-ইনভয়েসিং-ওভার-ইনভয়েসিং চক্র ও হুন্ডি-মানিলন্ডারিং সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে। বিপুল অর্থ বৈধ পথে ফিরে এসে ব্যাংকে জমেছে- এমনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
৩. ‘টাকা বৈধকরণ’: অর্থনীতি জানে, সংখ্যায় দেখা যায় না: গত এক বছরে করপোরেট ও রাজনৈতিক আঁতাত-সুবিধাভোগীরা কালো টাকা ব্যাংকিং মাধ্যমে বৈধ করেছে। এসব টাকা এখন ‘কোটিপতি আমানত’ হিসেবে ব্যাংকের হিসাব বইয়ে দৃশ্যমান।
মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সঞ্চয় সঙ্কুচিত : সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিপজ্জনক বার্তা
অন্য দিকে ছোট আমানতকারীর হিসাব গড়ে কমেছে, মাসিক আয় স্থির, কিন্তু পণ্যমূল্য বাড়ছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে, দৈনিক প্রয়োজন মেটাতে মানুষ সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে এক দিকে অল্পসংখ্যক মানুষের বড় অঙ্কের আমানত বাড়ছে, অন্য দিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঞ্চয়শক্তি ভেঙে পড়ছে। একে অর্থনীতিবিদরা এক কথায় বলছেন- ‘ভিতর থেকে পচন-মাথা ভারী অর্থনীতি।’
অর্থনীতির অন্ধকার দিকটি কোথায়- তদন্ত দাবি করছে নানা প্রশ্ন : এই প্রতিবেদনের পেছনের তথ্যগুলো আরো কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে- ১. বড় কোটিপতিদের এই অতিরিক্ত আয় কি কেবল বাজারের উৎপাদন থেকে এসেছে? উত্তর: না।
ব্যাংক খাতের ভেতরের লোকজন বলছেন, ‘এই বৃদ্ধির মধ্যে বিশুদ্ধ বাজার আয় নেই; রয়েছে অবৈধ আর্থিক প্রবাহের সাদা হওয়ার ধাপ।’
২. রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো কি এই প্রবাহকে রক্ষা করছে : বহু ব্যাংকে ইনসাইডার লোন, রাজনৈতিক নিয়োগ, ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ- সবই ধনীদের পক্ষে কাজ করছে।
৩. সাধারণ মানুষের আমানত কমছে- কিন্তু কোটিপতি বাড়ছে : বৈষম্যের এই গতি নিয়ন্ত্রণহীন হলে ব্যাংকিং সেক্টর মধ্যমেয়াদে ঝুঁকির মুখে পড়বে।
৪. বাংলাদেশ ব্যাংক কি নীরব দর্শক : বিভিন্ন পর্যবেক্ষক বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাগজে হিসাব প্রকাশ করছে ঠিকই; কিন্তু অস্বাভাবিক আমানত বৃদ্ধি, সন্দেহজনক ট্রানজেকশন, মূল্যস্ফীতির অজুহাতে মুনাফা লুকানোর কৌশল- এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর পরীক্ষা-তদারকি হয়নি।
বৈষম্য আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে : সমাজবিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন
বিশেষজ্ঞদের কঠোর সতর্কবাণী হলো- ১. সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া শুরু হলে সমাজে অস্থিরতা বাড়ে : ইতিহাস বলে, এই ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না।
২. অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনে : এটি কর্মসংস্থান সঙ্কট, দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক ক্ষোভ বাড়ায়।
৩. উৎপাদনমুখী খাতের মৃত্যু- অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ সঙ্কেত : ধনীরা বিনিয়োগ করছে না, ব্যাংকে অর্থ রেখে দিচ্ছে- এতে অর্থনীতি আরো সঙ্কুচিত হয়।
দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া বিপদ অনিবার্য : বিশেষজ্ঞদের মতে এখনই প্রয়োজন- ব্যাংকিং খাতে কঠোর সুশাসন; প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা বন্ধ করা; উচ্চ-আয়ের ওপর কার্যকর কর আরোপ; ‘ব্ল্যাক–মানি হোয়াইটনিং’ সুবিধা বাতিল; এসএমই ও সাধারণ আমানতকারীদের সুরক্ষা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায় অর্থনীতি আরো দুই মেরুতে বিভক্ত হবে- এক দিকে কয়েক হাজার কোটিপতি, অন্য দিকে কোটি মানুষ সঞ্চয়হীন ও ঋণে ডুবে থাকা জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটিপতি তালিকা শুধু আর্থিক পরিসংখ্যান নয়; এটি বর্তমান অর্থনীতির গভীর বৈষম্য, অস্বচ্ছ প্রবাহ এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের নগ্ন দলিল। এক বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া প্রমাণ করে- অর্থনীতি এখন দুই বিপরীত দিকে দৌড়াচ্ছে। এক দিকে সীমিত সংখ্যক মানুষ অভূতপূর্ব সম্পদ জমাচ্ছে, অন্য দিকে জনসংখ্যার বড় অংশ টিকে থাকার লড়াইয়ে। এ প্রবাহ থামাতে না পারলে অর্থনীতি শুধু সঙ্কটে নয়- সমাজও প্রবেশ করবে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার সন্নিকটে।



