- বইছে স্বচ্ছ পানি
- ধরা পড়ছে মাছ
- নৌকায় আনন্দভ্রমণ
ক্ষণস্থায়ী যৌবনে ফিরেছে মরা বুড়িগঙ্গা। আলকাতরার মতো কালো এবং দুর্গন্ধযুক্ত পানির বদলে নদীতে এখন বইছে স্বচ্ছ পানি। ধরা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। নেই কোনো আবর্জনা। নাক চেপে পারাপারের পরিবর্তে ভ্রমণপিপাসুরা এখন নদীতে ডিঙ্গি নৌকায় মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গোসল করতে এসে নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে স্থানীয়রা। এটা মরা বুড়িগঙ্গা নদীর বর্তমান অবস্থা।
বিশেষজ্ঞ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রতি বছর বর্ষায় এই নদী এমনি করে নতুন জীবন ফিরে পায়। বৃষ্টির কারণে পানি বাড়ায় নদীর পানিতে স্রোত দেখা দেয়। যার কারণে সব আবর্জনা ভেসে যায়। ফলে কুচকুচে কালো আর দুর্গন্ধযুক্ত পানির পরিবর্তে স্বচ্ছ টলটলে পানি বইতে থাকে। তবে এমনটি বেশি দিনের জন্য নয় জানিয়ে তারা বলেন, নদীর এমন যৌবন ক্ষণস্থায়ী। সর্বোচ্চ তিন মাস এ অবস্থা থাকবে। তারপর যখন থেকে বৃষ্টি কমতে শুরু করবে তখন থেকেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যৌবন হারাবে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ নদী।
একাধিক নৌকার মাঝি জানান, একসময় এ নদীতে ইলিশ মাছও পাওয়া যেত। ঢাকার মানুষের মাছের চাহিদার বড় অংশ সরবরাহ করত এ নদী। ফলে অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন তার উল্টো। জাল ফেলতেই উঠে আসে সাকার ফিশ। যদিও বর্ষায় অল্পপরিমাণ হলেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে নানা প্রজাতির দেশী মাছ। নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, স্বচ্ছ পানির সাথে বাতাসে নদীতে ঢেউ বইছে। সেই ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে নৌকা। শীতকালে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকলেও বর্ষা মৌসুমের কারণে রূপ আর রঙে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বছরের বেশির ভাগ সময় মানুষ যেখানে নাক চেপে নদী পার হন সেখানে এখন মুক্ত হাওয়ায় ঘুরছেন। পরিষ্কার পানিতে নদীতে দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসছেন ঘুরে বেড়াতে। একাধিক মাঝি জানান, গ্রীষ্মকালে নাকে রুমাল চেপে নৌকা চালালেও এখন তারা মনের সুখে যাত্রী পারাপার করেন। বিকেল হলেই বহু লোকজন ঘুরতে আসেন। তারা ঘণ্টা হিসেবে ভ্রমণ করেন। অনেকে শখ করে নৌকা চালান। আনন্দে তাদের সন্ধ্যা গড়ায়। কিন্তু এটা ভেবে তাদের কষ্ট হয় যে, নদীর এই যৌবন কয়েকদিন পরেই আর থাকবে না।
পরিবেশ অধিদফতর বলছে, কয়েক বছর আগে বুড়িগঙ্গার মিরপুর ব্রিজের কাছের পানিতে পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ ছিল শূন্য শতাংশ। কিন্তু বিগত বছরের বর্ষায় তা দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক শূন্য ২ মিলিগ্রামে।
অন্য দিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম বলছে, বিআইডব্লিউটিএ’র গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ১০ ফুট পলিথিনের স্তূপ জমে গেছে। তাদের ভাষ্য, বুড়িগঙ্গায় এই স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ধরে রাখতে হলে তলদেশে জমে থাকা অবশিষ্ট পলিথিনও দ্রুত অপসারণ করতে হবে। সেই সাথে বুড়িগঙ্গায় যাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে না পারে সে দিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। পলিথিন অপসারণ হলে কিছুটা হলেও স্বচ্ছ পানির দেখা মিলবে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাট টার্মিনাল এলাকার পানি সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার হয়। পানি বৃদ্ধির কারণে এ স্থানের চিত্র বদলে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গার অন্য অংশের পানির আরো বেশি উন্নতি হয়েছে। তবে বুড়িগঙ্গার কামরাঙ্গীরচর এলাকার পানি আরো বেশি স্বচ্ছ।
নদীতীরবর্তী বসবাসকারীরা জানান, বর্ষা আসার সাথে সাথেই নদীর পানির রঙ বদলাতে শুরু করেছে। এখন পানি পরিষ্কার; কিন্তু বর্ষা শেষ হলেই বুড়িগঙ্গার পানি কালো হয়ে যাবে। তখন পানি হাতে নেয়াই মুশকিল হয়ে যায়। পচা পানির গন্ধে তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা দেয় নানা রোগব্যাধি। তাদের ভাষ্য, আশপাশের ডায়িংগুলোসহ কলকারখানার দূষণ রুখতে পারলে সারা বছরই আগের মতো বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার থাকবে।
এ বিষয়ে বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছিলেন, ‘হাজারীবাগের ট্যানারির কারণে দূষিত হচ্ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। বেলার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের আদেশে ট্যানারি স্থানান্তর করার কারণে বুড়িগঙ্গার পানির ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যদিও ট্যানারি মালিকরা এখন ধলেশ্বরী নদী দূষিত করছেন। তার ভাষ্য, ‘বুড়িগঙ্গা নদীর এমন রূপ ধরে রাখতে হলে অন্য সব কারখানাকে আইন মেনে চলতে হবে’।