নিজস্ব প্রতিবেদক
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে আরো ছয় মাস সময় নিয়েছে বিভিন্ন এজেন্সির অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। সময় চেয়ে রাষ্ট্রপরে করা আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তে বিভিন্ন এজেন্সির অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করতে নির্দেশ দেন। একই সাথে তদন্ত শেষে ছয় মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। আদালতের আদেশের পর উচ্চমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়।
আগের ধারাবাহিকতায় গত ২২ এপ্রিল বিষয়টি আদালতে ওঠে। তদন্ত চলমান ও অগ্রগতি আছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ সেদিন ৯ মাস সময়ের আরজি জানায়। শুনানি নিয়ে আদালত ছয় মাস সময় মঞ্জুর করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার বিষয়টি আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
আদালতে রাষ্ট্রপে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ শুনানি করেন, সাথে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আখতার হোসেন মো: আবদুল ওয়াহাব। বাদিপে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রিট আবেদনকারীর পে শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
শুনানিতে বাদিপরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, সর্বশেষ গত ২২ এপ্রিল টাস্কফোর্সকে ছয় মাস সময় দেয়া হয়েছিল তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য। আদালত বলেন, উচ্চমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স কি গঠন হয়েছে? অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, গঠন হয়েছে এবং কাজও করছে।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘সর্বশেষ আদেশের আগেও তারা সময় নিয়েছিল। সময় নিয়ে প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কমিটি দায়িত্ব নিলেও কোনো প্রোগ্রেস (অগ্রগতি) দিতে পারছে না। প্রোগ্রেস না দিতে পারার কারণে আমরাও সংক্ষুব্ধ, দেশের মানুষও সংক্ষুব্ধ। ছয় মাস করে দুই ছয় মাস পার হয়ে গেছে। এখন তারা এসে এ বিষয়ে বলুক।’
রিট আবেদনকারী পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। আমরা কোনো এফিডেভিট (তদন্ত সম্পর্কে হলফনামা) পাইনি, হতে সময় লাগবে। আমরা কিছু পাচ্ছি না। এ জায়গায়তে আমরা অন্ধকারে আছি। তদন্ত সম্পর্কে লিখিত কিছু পাচ্ছি না, এত বড় টাস্কফোর্স গঠন করা হলো। কী হচ্ছে, না হচ্ছে না, সে বিষয়ে আদালতে অন্তত একটা রিপোর্ট আসুক।’
বাদিপরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে এক বছর আগে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম আদেশ হয়। এই আদেশের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয় ও কমিটি দায়িত্ব নেয়। যারা তদন্ত করছেন, তারা এসে বলুক তদন্তের অবস্থা, এফিডেভিট (হলফনামা আকারে) দিয়ে। আপডেট (হালনাগাদ) মানুষ জানতে চান। হালনাগাদ কিছু যদি জানে এটাও তো কিছু একটা প্রোগ্রেস। হালনাগাদ জানাতে কারও অসুবিধা থাকার কথা নয়।
একটি রিপোর্ট তুলে ধরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। অফিসার পরিবর্তন হয়েছে, ইটস অ্যা ভেরি ওল্ড কেস (এটি অনেক পুরনো মামলা)। তারা কাজ করছেন। কাজ করে অনেক দূর এগিয়েছেন। একটা রিপোর্ট অগ্রগতি বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা হচ্ছে।
বাদিপরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘এর একটা কপি আমাদের দেন।’ এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, রিপোর্টটি অফিসিয়ালি আসুক, রেজিস্টার জেনারেলের মাধ্যমে। আদালত বলেন, রিপোর্টটি কি অফিসিয়ালি দিচ্ছেন, নাকি আনঅফিসিয়ালি?
মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, আনঅফিসিয়ালি। রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে জমা হচ্ছে। নানা জায়গা থেকে তথ্য আসছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এক্সামিন (যাচাই) করতে হচ্ছে।...তদন্ত তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাবে।
আদালত বলেন, আগে একটা রেজিম (সরকার) ছিল। বর্তমান রেজিম এ ব্যাপারে সিরিয়াস। তখন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অবশ্যই।
আদালত বলেন, মনে হয় বেশি সময় দেয়া ঠিক না, তিন মাস দিচ্ছি। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, তিন মাসে পারবে না, ছয় মাস দেন। ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। বারবার আসতে চাচ্ছি না।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে যে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে, কোর্টে আসুক। বর্তমান সরকার আসার পর বিষয়টি ফোর্সফুল (জোরদার) হয়েছে। তবে এফিডেভিট দিয়ে যদি বলে এতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, আরো অগ্রগতি হবে, তাতে কার কী তি আছে?
শুনানির এই পর্যায়ে আবার ছয় মাস সময় দেয়ার আরজি জানান অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ। আদালত বলেন, এটা হবে লাস্ট টাইম (শেষবার)। আরশাদুর রউফ বলেন, ‘ছয় মাস না, পারলে এক সপ্তাহের মধ্যে করে দিই।’
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ছয় মাস সময় দেয়া হলে তখন নতুন রেজিম থাকবে। বর্তমান সরকার সিরিয়াসলি নিয়েছে, আরেক সরকার এসে সিরিয়াসলি নাও নিতে পারে। এর মধ্যে একটা তারিখ দেন।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তদন্ত তদন্তের মতো চলবে। সরকার কি পরিবর্তন হলো, না হলো, তাতে কিছু আসে যায় না। আদালত বলেন, ‘আমরা তিন মাস সময় দিচ্ছি।’ তখন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, ‘তিন মাসে হবে না। বারবার আসা, এটি আমরা চাচ্ছি না।’
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বারবার আসা মানেই তো ট্রাই (চেষ্টা) করছেন, যা পজিটিভ (ইতিবাচক)। নির্বাচনের (আসছে জাতীয় নির্বাচন) আগে একটা তারিখ দেন। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, ‘নির্বাচনের আগে দিলে পারবে না। আমরা বলেছি, এক মাসের মধ্যে দিতে। উনারা (টাস্কফোর্স) বলছেন সম্ভব নয়। যেটি সম্ভব নয়, সেটি বলে লাভ কী?’
একপর্যায়ে তিন মাস সময় দেয়ার অভিপ্রায় আবার ব্যক্ত করেন আদালত। তখন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আগেই বলছি তিন মাসে সম্ভবপর হবে না। আদালত বলেন, সম্ভব না হলে তারা এসে বলুক। তখন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা এসেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে উপস্থিত আছেন। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিজুল হক আদালত করে ডায়াসের সামনে আসেন। তার উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, আর কত বছর লাগবে? তের বছর হয়ে গেল। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, উনাদের কাছে কিন্তু এক বছর। তের বছরের ইতিহাস টানতে হলে অনেক কিছুই বলতে হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তার উদ্দেশে আদালত বলেন, কবে পারবেন? কতটুকু এগিয়েছেন? কত পার্সেন্ট? অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিজুল হক বলেন, ‘অনেকটুকুই এগিয়েছি। রিপোর্টটি আপনাদের সামনে।’ এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, অনেকেই নাই বা বাইরে চলে গেছে, অনেকে অ্যাড্রেস চেঞ্জ (ঠিকানা পরিবর্তন) করেছে। তাদের খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হচ্ছে। ইনভেস্টিগেশন (তদন্ত) সোজা জিনিস নয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তার উদ্দেশে আদালত বলেন, তিন মাসে পারবেন না? অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিজুল হক বলেন, ছয় মাস লাগবে। আদালত বলেন, ‘পজিটিভলি দিতে পারবেন? তাহলে আমরা ছয় মাস সময় দেব। আর যদি বলেন আরো সময় লাগতে পারে, তাহলে তিন মাস দেয়া হবে।’ আজিজুল হক বলেন, ইনশা আল্লাহ পারব। পরে আদালত ছয় মাস সময় মঞ্জুর করেন।



